গ্যাসের সরবরাহ সংকটের মধ্যেই চালু সংযোগ প্রদান, অগ্রাধিকার পাবে ইজেড–ইপিজেডের শিল্পগুলো

সরবরাহজনিত সংকটের কারণে গ্যাসের বাড়তি দামেও চাহিদা অনুযায়ী সংযোগ পাবে না সব শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। অর্থনৈতিক প্রভাব পর্যালোচনা করে – রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসহ পরিকল্পিত শিল্পনগরীতে স্থাপিত রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানাগুলোকে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়ার পাশাপাশি – চালু থাকা কারখানার লোড বৃদ্ধি করা হবে।
এসব নির্দেশনা দিয়ে নতুন গ্যাস সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির আবেদনগুলো 'ফার্স্ট কাম, ফার্স্ট সার্ভ' ভিত্তিতে সংযোগ পাওয়ার যোগ্য কোম্পানিগুলোর তালিকা তৈরি করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বুধবার বিতরণ কোম্পানিগুলোকে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
নতুন সংযোগ দেওয়া ও লোড বৃদ্ধিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানছে কি-না, তা যাচাই করার পর বিতরণ কোম্পানিগুলো বোর্ডের অনুমোদন সাপেক্ষে সংযোগ দেবে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা।
যেসব কারখানায় নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে, তারা যেন পর্যাপ্ত গ্যাসের প্রেসার পায় তা নিশ্চিত করাসহ – ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে গ্যাসের সিস্টেম লস অর্ধেকে নামিয়ে আনতে একটি সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ প্রণয়ন করে – তা কার্যকর করতে পেট্রোবাংলা, সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলসহ সকল বিতরণ কোম্পানিকে নির্দেশনা দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
এছাড়া, শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে আবাসিক গ্রাহকদের চুলায় গ্যাসের প্রেসার আরও কমতে পারে বলে জানান জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তিনি জানান, সরকার ঘোষণা দিয়ে আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নেবে না। তবে আগামী দিনগুলোতে আবাসিকে গ্যাসের প্রেসার এমনভাবে কমতে থাকবে, যাতে বিদ্যমান আবাসিক গ্রাহকরা বাধ্য হয়ে এলএনজি ব্যবহারে উৎসাহিত হয়।
বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ); যার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে প্রায় ২৭০০ এমএমসিএফ। এর মধ্যে মাসে সিস্টেম লসের পরিমাণ ২৪০ এমএমসিএফ – বছরে সিস্টেম লসের কারণে এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের গ্যাস অপচয় হচ্ছে।
গ্যাসের সিস্টেম লস কমাতে বুধবার জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে পেট্রোবাংলা, জিটিসিএল, তিতাসসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সিস্টেম লস কমাতে প্রত্যেক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব বন্টন করে দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। যেসব কর্মকর্তা টার্গেট পূরণ করতে পারবেন— তাদের জন্য পুরস্কার, এবং যারা ব্যর্থ হবেন— তাদের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান টিবিএসকে বলেন, নতুন শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সিস্টেম লস অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সকল কোম্পানিকে টাইমবাউন্ড রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছে। এই রোডম্যাপ কতোটা বাস্তবায়ন হচ্ছে, তা প্রতি তিন মাস অন্তর যাচাই করা হবে।
তিনি আরও বলেন, গ্যাসক্ষেত্রের নতুন অনুসন্ধান থেকে আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে অল্প অল্প গ্যাস পাওয়া যাবে। কোথাও ৮ এমএমসিএফ, কোথাও ২০ এমএমসিএফ।
'নতুন সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে গ্যাসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হবে। যেখানে সরবরাহ করা সম্ভব হবে না, সেখানে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে না। ইকোনমিক ইম্প্যাক্ট (বা অর্থনীতিতে গুরুত্ব/অবদান) যাচাই করে ইপিজেড, ইকোনমিক জোনে অবস্থিত রপ্তানিমুখী কারখানায় গ্যাস সংযোগে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে'- যোগ করেন জ্বালানি উপদেষ্টা।
গত কয়েকমাস ধরে নতুন শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল নতুন শিল্পে গ্যাসের মূল্য ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা, এবং ক্যাপটিভ জেনারেটরে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। এছাড়া, অনুমোদিত লোডের অতিরিক্ত লোডের ক্ষেত্রেও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির কাছে নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির প্রায় ১,০০০ আবেদন জমা রয়েছে, যার মধ্যে শুধু তিতাস গ্যাসের কাছেই জমা আবেদনের সংখ্যা ৪৫০ এর বেশি। কিন্তু, গ্যাস সরবরাহের বিদ্যমান সক্ষমতায়— চাহিদা অনুযায়ী সকল প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না।
এজন্য কোন ধরণের কোম্পানি গ্যাস সংযোগে অগ্রাধিকার পাবে এবং কারা সংযোগ পাবে না, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। আবেদনগুলোর মধ্য থেকে কোন কারখানায় গ্যাস সংযোগ দিলে অর্থনীতিতে কতোটা প্রভাব ফেলবে, তা বিবেচনা করে ইপিজেড ও পরিকল্পিত শিল্পনগরীতে স্থাপিত রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানাগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে গ্যাস সংযোগ দিতে হবে।
এছাড়া বন্ধ কারখানা বা অনুৎপাদনশীল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ না দিয়ে— চালু শিল্প কারখানার লোড বৃদ্ধিতে অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। নতুন সংযোগ দিতে গ্যাস পাইপলাইনের কাছাকাছি অবস্থিত কারখানাগুলো গুরুত্ব পাবে; তবে গ্যাসের চাপ কম থাকায় পাইপলাইনের শেষ প্রান্তের স্থাপিত কারখানাগুলো সংযোগ পাবে না।
এই সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনের তারিখ বিবেচনায় নিয়ে— অগ্রাধিকারের তালিকা প্রস্তুত করে জ্বালানি বিভাগে পাঠাতে হবে। পরে জ্বালানি বিভাগ তালিকা পর্যালোচনা করে সম্মতি দেওয়ার পর, কোম্পানিগুলোর বোর্ডে অনুমোদন সাপেক্ষে সংযোগ দিতে হবে।
এছাড়া সরকার গ্যাসের বাড়তি চাহিদাকে পর্যালোচনা করে— তা পূরণে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেবে।
ওই কর্মকর্তা জানান, 'জ্বালানি উপদেষ্টা স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন যে, যেসব কারখানায় নতুন সংযোগ দেওয়া হবে বা লোড বৃদ্ধি করা হবে— সেসব গ্রাহককে তার চাহিদা অনুযায়ী, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। এজন্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী পেট্রোবাংলা গ্যাস বরাদ্দ রি-এলোকেট করবে।'
গ্যাস সরবরাহ না বাড়িয়ে নতুন শিল্পে কিভাবে সরবরাহ বাড়ানো হবে— এমন প্রশ্নে জ্বালানি বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, এজন্যই সিস্টেম লস কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মোট গ্যাস বিতরণের ৬০% সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। গত জানুয়ারিতে তাদের সিস্টেম লস ছিল ১০.৫৩%, যা ২০২৬ সালের জুনে ৫% -এ নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে। তিতাস গ্যাস জানিয়েছে যে, তারা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সিস্টেম লস কমাতে পারবে। জানুয়ারিতে বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির সিস্টেম লস ছিল ১৩.৬০%, আগামী বছরের জুনের মধ্যে তাদেরকেও ৫%- এ নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে।
সঞ্চালন কোম্পানি হিসেবে জিটিসিএল এর কোন সিস্টেম লস থাকার কথা নয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কোম্পানিটির সিস্টেম লসের পরিমাণ ২.২৩%। আগামী বছরের জুনের মধ্যে এটি কমিয়ে ১% করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তিতে সিস্টেম লস কমানোর লক্ষ্যমাত্রাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো গ্যাস সংকটের থাকা অর্থনীতিতে এতো বেশি সিস্টেম লসের ভার বহন করা— অর্থনীতি ও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।'
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গ্যাসের সিস্টেম লস কমাতে নারায়ণগঞ্জে তিতাস গ্যাস কোম্পানি একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির সিস্টেম লস কমাতে প্রকল্প নেওয়ার বিষয়েও আলোচনা চলছে।