আরও ৫৭ হাজার কোটি টাকা আদায়ে চাপ দিচ্ছে আইএমএফ, নইলে বিলম্ব হতে পারে ঋণের কিস্তি ছাড়ে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানুয়ারিতে অপ্রত্যাশিতভাবে কর বৃদ্ধির পর বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা থেকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এখন আরও কর বাড়ানোর চাপ দিচ্ছে। সংস্থাটি চায়, বাংলাদেশ আগামী অর্থবছরে কর ছাড় কমিয়ে ও করের হার বাড়িয়ে অতিরিক্ত ৫৭ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করুক।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, এ অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহ করা না গেলে আইএমএফ-এর ঋণের চতুর্থ কিস্তি—যা ইতোমধ্যে মার্চ থেকে বিলম্বিত হয়েছে—এবং আসন্ন পঞ্চম কিস্তি পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
আইএমএফ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দাবিগুলো জানায়নি। তবে ৬ এপ্রিল ঢাকায় সংস্থাটির প্রতিনিধি দল আসার পর আনুষ্ঠানিকভাবে এসব শর্ত উপস্থাপন করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এনবিআরের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন। তাদের মতে, শুধু কর ছাড় কমানো বা বিদ্যমান করের হার বাড়িয়ে এত বড় অঙ্কের রাজস্ব সংগ্রহ সম্ভব নয়—বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন দেশের অর্থনীতি মন্থর প্রবৃদ্ধি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, উৎপাদন সংকট ও কর্মসংস্থানের স্থবিরতার মতো সমস্যার মুখোমুখি।
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চ্যালেঞ্জ
'জানুয়ারির কর বৃদ্ধির ধাক্কা এখনও পুরোপুরি সামলানো যায়নি। তাছাড়া সব কর ছাড় একসঙ্গে বাতিল করাও সম্ভব নয়,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন এনবিআরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইএমএফের কঠোর ঋণ শর্ত মেনে চলা বাংলাদেশের জন্য আদর্শ না-ও হতে পারে।
'সরকার যদি আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চেষ্টা করে, তাহলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হবে। আদতে শুধু কর বাড়িয়ে বা ছাড় কমিয়ে এত বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় করা সম্ভব নয়,' বলেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ।
তিনি উল্লেখ করেন, অতীতে অনেক দেশ আইএমএফের শর্ত মেনে চলতে গিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। তার মতে, বাংলাদেশকে নিজস্ব সক্ষমতার ভিত্তিতে অর্থনীতি পরিচালনার পরিকল্পনা নিতে হবে।
'আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সুপারিশের কারণে আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়া উচিত নয়। তাছাড়া আমাদের তাদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়ারও সুযোগ নেই,' তিনি বলেন।
২০২৩ সালের শুরুতে স্বাক্ষরিত ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির অংশ হিসেবে আইএমএফ ৩০টিরও বেশি সংস্কারের শর্ত দিয়েছে, যার মধ্যে বার্ষিক রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যও অন্তর্ভুক্ত। তবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
জানুয়ারিতে ভ্যাট ও কর বৃদ্ধির পরও রাজস্ব আদায় প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতিগত পদক্ষেপ নিয়ে মতবিরোধের কারণে চতুর্থ ঋণের কিস্তি ছাড়ে বিলম্ব হচ্ছে।
বাংলাদেশ আগামী জুন মাসে দুটি কিস্তি পাওয়ার আশা করছে। তার আগে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের অগ্রগতি মূল্যায়ন করতে ঢাকা সফর করবে। সূত্র জানায়, ৬ এপ্রিল প্রতিনিধিদলটি অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে এবং পরদিন এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআর ৩.৮২ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করেছিল, যা ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় হয়েছে ২.১৮ লাখ কোটি টাকা, আর প্রবৃদ্ধি নেমে গেছে দুই শতাংশের নিচে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪.৮ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও পরে তা সংশোধন করে ৪.৬৩ লাখ কোটি টাকা করা হয়েছে।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানান, সংস্থাটি কখনও কোনো অর্থবছরে কেবল কর বৃদ্ধির মাধ্যমে ৫৭ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে পারেনি।
কর ছাড়: সীমিত সমাধান
তাছাড়া, কর ছাড় কমিয়ে কতটুকু অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে, সে বিষয়ে এনবিআর আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো গবেষণা করেনি। তবে কর্মকর্তাদের ধারণা, এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত আয় হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং আমদানি শুল্ক মিলিয়ে কর ছাড়ের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। তবে এ ছাড় কমিয়েও রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে না কেন?
এনবিআরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে কিছু কর ছাড় পুরোপুরি তুলে দেওয়া সম্ভব নয়।
তার মতে, নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য কিছু কর ছাড়—বিশেষ করে আয়করের ক্ষেত্রে—বাতিল করা যেতে পারে। তবে, তা রাজস্ব আদায়ে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে এমন নিশ্চয়তা নেই।
যেমন, সরকার প্রতি বছর মৎস্য খাতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা কর ছাড় দেয়। এ সুবিধার আওতায় অনেকেই তাদের প্রকৃত আয়ের তুলনায় কম কর প্রদান করেন। তিনি বলেন, 'যদি এ কর ছাড় প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে মৎস্য খাতে দেখানো আয়ের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে কমে যাবে, ফলে প্রকৃত কর আদায়ও ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে।'
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কেবল কর ছাড় কমানোর সুপারিশ করেনি, বরং কিছু নির্দিষ্ট খাতে নতুন বা বর্ধিত কর আরোপের পরামর্শও দিয়েছে। তবে, শুধু কর হার বাড়ালেই যে রাজস্ব বাড়বে, তা নিশ্চিত নয়।
এর একটি উদাহরণ তামাক খাত। গত নয় মাসে দুই দফা কর বৃদ্ধির পরও বিক্রি কমে যাওয়ায় এ খাত থেকে প্রকৃত রাজস্ব পূর্বাভাসের অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে।
একইভাবে রেমিট্যান্সের ওপর করমুক্ত সুবিধা অপসারণ করলে রেমিট্যান্স প্রবাহ নিরুৎসাহিত হতে পারে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে প্রভাবিত করতে এবং অর্থনীতির ওপরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা বলেন, শুধু কর বাড়ালেই রাজস্ব বাড়বে না। কর ফাঁকি রোধ, করজালের সম্প্রসারণ এবং করদাতাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য অটোমেশন ব্যবস্থা উন্নয়ন করা জরুরি বলে পরামর্শ দেন তিনি।
সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্ক
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এনবিআরের এ অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, 'এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে সদিচ্ছার অভাব করব্যবস্থার সংস্কারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
২০২৩ সালের শুরুতে আইএমএফ শর্ত দিয়েছিল যে, তিন বছরে (২০২৪-২০২৬) কর-জিডিপি অনুপাত ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়াতে হবে। তখন এটি ছিল ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২৪ সালের মধ্যে এটি আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী ৮ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত এ হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম রয়েছে।
মার্চের এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান জানান, বর্তমানে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা কম সংগ্রহ করেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আদায় ব্যাহত হয়েছে।
১৬ মার্চ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পূর্বাভাস দিয়েছে, এ ঘাটতি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা কর-জিডিপি অনুপাতের সংকট আরও বাড়াবে।
ঋণ ছাড় নিয়ে অনিশ্চয়তা
আইএমএফের সংস্কার পরিকল্পনার বড় অংশ এনবিআর বাস্তবায়ন করলেও সরকার এখনও কিছু প্রধান শর্ত পূরণ করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশিরভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—একটি একীভূত ভ্যাট হার চালু করা, রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার গ্রহণ এবং সরকারি ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগ।
বিশেষ করে, রাজস্ব ঘাটতি এবং বাজারভিত্তিক বিনিময় হার না থাকায় আইএমএফ সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। ফলে সংস্থাটি ঋণের নির্ধারিত কিস্তি প্রদানে বিলম্ব করছে।
ড. জাহিদ হোসেন সতর্ক করে বলেন, 'আইএমএফ যদি ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখে, তাহলে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলোও তাদের বাজেট সহায়তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসতে পারে।'