আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় মেঘনা, এনআরবিসি, এনআরবি ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও ব্যাংকিং কার্যক্রমে শৃঙ্খলা আনতে তিনটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে।
বুধবার (১২ মার্চ) ঘোষিত এ সিদ্ধান্ত মেঘনা ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক ও এনআরবি ব্যাংকের জন্য নেওয়া হয়েছে। চতুর্থ প্রজন্মের এই তিন ব্যাংক ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ করেছে, যা এসব ব্যাংকের তত্ত্বাবধান করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানানো হবে।
এই ব্যাংকগুলোর পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে কয়েকজন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রক নীতিমালা বাস্তবায়ন নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি কার্যক্রম জোরদার করেছে।
গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এবং আহসান এইচ মনসুরকে গভর্নর নিয়োগ দেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করেছে।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের স্বাক্ষরিত এবং তিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের নীতিগত দুর্বলতার কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে, যা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এসব বোর্ড ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের পরিপন্থী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল, যা আমানতকারীদের স্বার্থের জন্য হুমকি।
বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের ৪৭(১) ও ৪৮(১) ধারার অধীনে জনস্বার্থ রক্ষায় বিদ্যমান বোর্ড বাতিল করেছে এবং নতুন বোর্ড গঠন করেছে বলে চিঠিতে জানানো হয়েছে।
বিলুপ্ত একটি বোর্ডের এক সাবেক চেয়ারম্যান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খুব একটা দুর্বল ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগেই দুর্বল ব্যাংকের তালিকা করলেও এই তিন প্রতিষ্ঠান সেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
তিনি দাবি করেন, এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যা তাদের আওয়ামী লীগের সাবেক সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পুনর্গঠনের ফলে আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হতে পারে এবং তারা ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার চাপ সৃষ্টি করতে পারেন।
সাবেক এ চেয়ারম্যান জানান, তিনিসহ ব্যাংক তিনটির সম্প্রতি বহিষ্কৃত চেয়ারম্যানরা বিদেশে অবস্থান করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের প্রতি অর্থবছরে অন্তত দুইবার সভায় উপস্থিত থাকতে হয়। তবে অর্থবছর শেষ না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতি কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করেনি বলে তিনি দাবি করেন।
আইনি বিতর্কের মধ্যে মেঘনা ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন
বোর্ড বাতিলের আগে মেঘনা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক সংসদ সদস্য এইচএন আশিকুর রহমান।
চলতি বছরের মার্চে, জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার দিন রংপুরের মিঠাপুকুরে এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আশিকুর রহমানসহ ২২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়।
মেঘনা ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার উজমা চৌধুরী, ক্যাসিওপিয়া ফ্যাশন লিমিটেডের প্রতিনিধি পরিচালক তানভীর আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক মো. মামুনুল হক ও মো. রোজব আলীর মতো স্বাধীন পরিচালক।
এছাড়া আরও যোগ দিয়েছেন যমুনা ব্যাংকের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম, প্রাইম ব্যাংকের প্রাক্তন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এফসিএ মো. আলী আখতার রিজভী।
এনআরবিসির প্রাক্তন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আর্থিক অপরাধের অভিযোগ
এদিকে, বিলুপ্ত এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের বিরুদ্ধে আর্থিক অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্দেশে গত বছরের নভেম্বর মাসে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। একই আদেশে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমাম এবং আর্থিক প্রশাসন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জাফর ইকবাল হাওলাদারের অ্যাকাউন্টও জব্দ করা হয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার একটি আদালত শেয়ারবাজার কারসাজি, আর্থিক অপরাধ, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে এনআরবিসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
নবগঠিত এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন স্বাধীন পরিচালক মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া, যিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
নতুন পরিচালনা পর্ষদে আরও রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক মো. আবুল বাশার ও মো. আনোয়ার হোসেন, সোনালী ব্যাংকের প্রাক্তন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল হক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. শফিকুল রহমান, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের অধ্যাপক সৈয়দ আবুল কালাম আজাদ এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ।
নতুন চেয়ারম্যান ছাড়াই এনআরবি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন
অন্যদিকে, এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান (নাসির) অপসারিত হলেও এখনো নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
তবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। নতুন পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার ইকবাল আহমেদ ওবিই, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাক্তন বোর্ড সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক শেখ মো. সেলিম, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাইম ব্যাংকের প্রাক্তন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মতিউর রহমান, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক শরীফ নূরুল আহকাম এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মিজানুর রহমান এফসিএ।
তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অনুপাত
২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ তিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ৬ শতাংশের নিচে, যেখানে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে এই হার ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। তবে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ এটি বেড়ে ১৭ শতাংশে পৌঁছায়।
২০২৩ সালের হিসাব অনুসারে, এনআরবি ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ৬,৬৮৫ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ঋণ ও অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল ৬,০০৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪.৯৮ শতাংশ।
এনআরবিসি ব্যাংকের মোট ঋণ ও অগ্রিম ছিল ১৪,৫০৯ কোটি টাকা, যেখানে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭,৫৬৭ কোটি টাকা। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫.৩৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, মেঘনা ব্যাংকের মোট ঋণ ও অগ্রিম ছিল ৫,২০৪ কোটি টাকা, যার বিপরীতে আমানত ছিল ৬,৫০২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪.৫৩ শতাংশ।