বাজেটের ৫০ বছর এবং আমাদের বিভাজিত সমাজ-রাজনীতি

৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেটের দেশ বাংলাদেশ। সেই দেশটি আজ প্রায় সাত লক্ষ কোটি টাকার বাজেটের দেশে উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে এই সময়ের শাসনকালের সবারই কিছু না কিছু ভূমিকা আছে। বর্তমান সরকার একনাগাড়ে সাড়ে তেরো বছর ক্ষমতায় আছে। তাদের রাজনৈতিক অনুসারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের একক দাবিদার হিসেবে নিজেদেরকে বারবার তুলে ধরছে। দলটির ক্ষমতায় আরোহণের সময় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিল পদ্মা সেতু। ক্ষমতায় আরোহণের প্রথম সময়েই পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল, তা ছিল পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে পদ্মা সেতু আজ একটি বাস্তবতা। সেতুটির নির্মাণব্যয় শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে যতই মতান্তর থাকুক না কেন এটি একটি বাস্তব কথা, এ ধরনের প্রতিটি বড় প্রকল্পের ব্যয়ের হিসাব আগাম কখনোই সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব না।
পদ্মা সেতু নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলছে বর্তমান সরকার। তথ্য পর্যালোচনা করলে তার দাবির পেছনে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেখানে দেখা যায় এ দেশের অভ্যন্তরেই পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের প্রশ্নে সামাজিক বিভাজন ছিল। আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছিল পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে, তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছিল সমাজের এ অভ্যন্তরীণ শক্তি। সামাজিক বিভাজনের এই শত্রুতার শুরু বহুকাল যাবৎ, এবং তা এখনও অব্যাহত আছে।
আজ অবধি যা লক্ষ করা গেছে তা হলো: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা এই সামাজিক বিভাজন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই চলমান রয়েছে। প্রতিটি বাজেটের ক্ষেত্রে আমরা দেখি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বিভাজিত থাকে, এক পক্ষ অপর পক্ষকে দায়ী করে এবং ভুল হিসেবে তুলে ধরে বাজেটের। তারপরও দেশ ঠিকই চলছে। এভাবেই ৫০ বছর পার করলাম আমরা।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিভাজন আস্তে আস্তে আরো বেশি তীব্র হয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। প্রধান রাজনৈতিক দলটির প্রধান ব্যক্তিকে একটি অর্থনৈতিক দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত করে সাজা প্রদান করা হয়। পরবর্তীকালে প্রধান আসামিকে নিম্ন আদালত কর্তৃক যে সাজা প্রদান করা হয়েছিল তা বৃদ্ধি করে ১০ বছর করা হয়। সাধারণভাবে আমাদের দেশের আইন অনুসারে আপিল অবস্থায় আসামিদের জামিন পাওয়ার কথা। তবে ভিন্ন অতীত ইতিহাসও আছে, সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা ত্যাগের পরে বিনা বিচারে প্রায় পাঁচ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। বিচারিক আদালত কিংবা উচ্চ আদালত কেউ তাকে জামিন মঞ্জুর করেননি। তখনকার বিচার বিভাগের এই সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল কি না, এ প্রশ্ন জাগাতে পারে কারো কারো মনে। বিচারিক আদালত কিংবা উচ্চ আদালতের জামিন দেওয়া আদালতের এখতিয়ার। তথাপি এরশাদের মতন একজন পরিচিত ব্যক্তির দেশ ত্যাগ করা, কিংবা মামলাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তার তখন ছিল না। তা সত্ত্বেও তাকে জামিন দেওয়া হয়নি। এরশাদের কারাভ্যন্তরে থাকার পেছনে নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের প্রধান্য ছিল তাহলে!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন খালেদা জিয়া। গত কয়েক মাস যাবত তিনি মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তিনি যেসব রোগে আক্রান্ত তার মধ্যে প্রাণঘাতী রোগ আছ, লিভার সিরোসিস। এমনি সব রোগে আক্রান্ত একজন মানুষকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যেতে না দেওয়া এখন রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। '১৮ সালের নির্বাচনের সময় কারাঅন্তরীণ খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা বলে দলের মধ্যকার কিছু লোক পর্দার অন্তরালে আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন নির্বাচনী সাফল্য অর্জন করেছিলেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে প্রথমে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল উচ্চ আদালতে আপিলের প্রেক্ষিতে। সেই বিচার আদালতের রায়, উচ্চ আদালতের এখতিয়ার অনুসারে তাকে দশ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটি মামলার সাজা নিষ্পত্তি হয়েছে; এছাড়া আরো অনেক মামলা আছে। কোনো একটি মামলায় উচ্চ আদালত কর্তৃক জামিন প্রদান করা হয়েছিল, কিন্তু অপর আদালত থেকে জামিন না মেলায় খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পাননি। করোনা পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়াতে খালেদা জিয়া বাসায় অন্তরীণ অবস্থায় সময় কাটাচ্ছেন।
বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকটের এমনি একটি সময়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্যের সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় বিদেশ গমন করা এবং বিদেশ থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে এসে আদালতে আত্মসমর্পণ করার ঘটনাও দেশবাসীর চোখ এড়ায়নি। যদিও ওই সংসদ সদস্যের বিদেশ গমনকে আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জনগণের কাছে সে বৈধতার ব্যাখ্যাটি এখনো স্পষ্ট নয় যে কোন বিধান বলে ঘটনাটিকে বৈধ বলে উল্লেখ করা হলো।
৭৬ বছর বয়সী খালেদা জিয়া কী কারনে চিকিৎসার জন্য বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি পাচ্ছেন না, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে সাধারণভাবে জনগণ এ বিষয়টিকে এক ধরনের নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে করছে।
অভ্যন্তরীণ সামাজিক ঐক্য না ঘটলে দেশের কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়নই স্থায়ী হতে পারে না। প্রধান দুই রাজনৈতিক ধারার বিভাজনের পরিণতিতে ধর্মীয় মৌলবাদের ব্যাপক বিকাশ ঘটছে। ভারতীয় নুপুর শর্মা ও জিন্দালের কাহিনীর পর ধর্মীয় সংগঠনগুলো রাস্তা যেভাবে গরম করেছে কিংবা যে হাজার হাজার মানুষকে তাদের মিছিলে সমবেত করেছে, তা অবশ্যই উদ্বেগের। এমনকি এই ইস্যুতে মিছিলগুলোতে স্কুল পর্যায়ের, অর্থাৎ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। যদিও সরকারের অবস্থান ভিন্ন। ভারতের এই মৌলবাদী বিষয়টা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখছে আমাদের সরকার। দেশের বিবেকবান মানুষেরও একই দৃষ্টিভঙ্গি। ভারতের এই বিষয়টিতে বাংলাদেশের সমাজে যেন কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয় সেদিকে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। স্থায়ী সামাজিক ঐক্য সৃষ্টি না হলে এই ধরনের ঘটনাকে মৌলবাদীরা নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগাবে।