ইউক্রেন-রাশিয়া বিরোধ স্পষ্ট করেছে ছোট অর্থনীতির দেশগুলো বড় দেশগুলোর চোখ-রাঙানির সম্মুখীন

আটলান্টিক মহসাগরের দুই পাড়ের ১২টি দেশ নিয়ে ১৯৪৫ সালে উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট, ন্যাটো তার যাত্রা শুরু করে। ন্যাটোর ছাতায় এখন ৩০টি দেশ এবং ক্রমশ পূর্ব দিকে ধাবমান। সাবেক সোভিয়েতের ৩টি দেশ লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া ও লাটভিয়া একই সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদতে ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার চেষ্টা থেকে সরে আসে। ইউক্রেনের জনগন এটা মেনে নেয়নি। তীব্র আন্দোলনের মুখে ভলোদিমির জলেনস্কির পূর্বসূরী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং রাশিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দুটি অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশভাষী। রুশভাষী দুটি বিদ্রোহী গ্রুপ এই দুই অঞ্চলের স্বাধীনতা দাবি করে আন্দোলন করতে থাকে। এতদিন ধরে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভরোদিমির জলেনস্কি রাশিয়া ইন্ধনের অভিযোগ করে আসছিল। চলমান উত্তেজনার মধ্যেই ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুতিন এই দুই অঞ্চলকে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জলেনস্কির সামনে বিকল্পগুলো কী ছিল? দাসত্ব মেনে নেওয়া কোনো বিকল্প হতে পারে না। বিকল্প একটাই, রাশিয়ার এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করা। একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য তৈরি হওয়া। কিন্তু সেটা কখন? একটি অসম যুদ্ধের সামনে নিজ দেশের জনগণকে ঠেলে দেওয়া আত্মহত্যার সামিল। রাশিয়া পৃথিবী অন্যতম পারমাণবিক ও সামরিক শক্তিধর দেশ। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ভলোদিমির জলেনস্কি যথেষ্ট ভাবার সুযোগ পেয়েছিলেন কিনা। নাকি ইঙ্গ-মার্কিন 'লাগাতার চেষ্টায়' শেষমেশ যুদ্ধটা বাধাতে সক্ষম হলো।
জো বাইডেন এবং বরিস জনসনের একান্ত নিজস্ব প্রয়োজনে এই যুদ্ধের দরকার ছিল। বরিস নিজ দেশে ক্ষমতা হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে। গতবছর করোনার ভীষণ নাজুক পরিস্থিতির সময়ে যখন সারাদেশে লকডাউন চলছে তখন নিজ অফিসে মদের "পার্টি" করার অভিযোগ উঠেছে বরিস জনসনের বিরুদ্ধে। কেবল বিরোধী দল নয় নিজ দলের তীব্র সমালোচনার মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
জো বাইডেন নির্বাচনে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বা ইস্যুগুলোকে সামনে এনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল তার অনেক কিছু এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। জো বাইডেনের জনপ্রিয়তাও এখন হুমকির মুখে। ট্রাম্পের জামানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিহীন অবস্থায় ছিল। সে তুলনায় ইউরোপের এই যুদ্ধকে উস্কানি দিয়ে যে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। যদিও এই সময়ে কেবল মার্কিন জনগণ নয় কোন দেশের মানুষ যুদ্ধকে সমর্থন করবে না। করোনা প্যানডামিক মানুষের জীবন ও অর্থনীতি নাজুক করে তুলেছে। করোনা আতঙ্কগ্রস্থ মানুষ যুদ্ধ চায় না। ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধের বিরুদ্ধে খোদ রাশিয়াতেই ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। যুদ্ধ বিরোধী মার্কিন জনগণের বর্তমান মনোভাব উপেক্ষা করা বাইডেনের জন্য সহজ হবে না।
জো বাইডেন এবং বরিস জনসন খুব জোরের সাথে মস্কোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, পুতিন ইউক্রেন দখল করে নেবার আগে দেশটাকে ভেঙ্গে টুকরা করে ফেলছে। আমরা জানি, ইউক্রেনের পূর্বাংশ দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক দুটোই রুশ ভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রায় ৭০ শতাংশ। এমন কি ইউক্রেনে ৩০ শতাংশ মানুষ রুশভাষী। পশ্চিমারা কখনোই জানতে চায়নি, দোনেৎস্ক বা লুহানস্ক এর জনগণ কী চায়। ব্রিটেনে স্কটল্যান্ড বা ওয়েলসের জনগন যদি ব্রিটেনের সাথে থাকতে না চায় বা আমেরিকার টেক্সাসের মানুষ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকতে না চায়, তখন আমেরিকা বা ব্রিটেনে তার নিজের দেশের জন্য কী করবে? আমরা কোনোভাবেই চলমান যুদ্ধকে সমর্থন করি না। কিন্তু ইউক্রেনের দুই ভূখন্ড নিয়ে মার্কিন ও ব্রিটেনের আপত্তি যুক্তির বিচারে টেকে না।
যুদ্ধবাজ দেশগুলোর হাতে যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ রয়েছে তার কিয়দাংশ এই পৃথিবী ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপের ধনী দেশগুলো, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া মিলিতভাবে যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে তার পরোক্ষ শিকার হবে আমাদের মত ছোট অর্থনীতির দেশগুলো।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম হুহু করে বাড়ছে। আমাদের মতন দেশ সহ আরো বেশ কিছু দেশ খাদ্যের নির্ভরতা আছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার উপরে। আমাদের দেশের গম সরবরাহকারীদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এই দেশগুলো। সে জায়গায় এসে যে ধরনের নিষেধাজ্ঞা তৈরি করা হচ্ছে, তাতে আমরা হয়তো এই আমাদের খাদ্য সরবরাহের এই চ্যানেলটি হারিয়ে ফেলবো। এই অবেরোধ তাদের নিজ দেশের অভ্যন্তরে কী সংকট সৃষ্টি হবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না যদিও তারা অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও তাদের অর্থনীতির চূড়ান্ত পরিণতি হয়তো আমরা এখনই বুঝতে পারব না। তবে আমরা এটা নিশ্চিত যে, আমাদের উপর একটা বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে।
ইউক্রেনের অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ, পৃথিবীর ছোট দেশগুলোকে ভাবিয়ে তুলবে। আমাদের মত কম শক্তিধর ছোট দেশগুলোর বৃহৎ শক্তির দেশগুলোর কাছ থেকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা কতটুকু তা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন হল। ইউক্রেনের অভ্যন্তরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমাধানের নামে যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলা পুতিনের কতটা দূরদর্শিতা আছে তা প্রমাণ হবে আগামীতে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ছোট অর্থনীতি এবং ছোট দেশগুলো বৃহৎ দেশগুলোর চোখ-রাঙানির সম্মুখীন। আবারো প্রমাণিত হলো, জাতিসংঘসহ বিশ্বপ্রতিষ্ঠানগুলো সাম্য, ন্যায্যতা ও সামগ্রিক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ।
বাংলাদেশে গত এক দশক যাবত চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করছে। ঘুষ দুর্নীতির কথা বলে পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ প্রজেক্ট পদ্মা সেতু বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পশ্চিমা বিশ্ব, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এইপ্রকল্প থেকে অর্থের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরে এক চরম অনিশ্চয়তার সময় চীন বাংলাদেশের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এই প্রকল্প এখন সমাপ্তির পথে। পদ্মা সেতু ছাড়াও আরও অনেক বড় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাংলাদেশে চলমান।
সেগুলোর জন্যেও অনেক অর্থায়নের চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। এ রকম অবস্থায়, একদিকে চীন এককভাবে উদার অর্থনৈতিক কৌশল নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে এবং অপর প্রান্তে চীন বিরোধী অকাস বা কোয়াডের মত বিভিন্ন জোট। বাংলাদেশ কোথায় যাবে? গত ১৯ তারিখে জার্মানির মিউনিখে ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শংকরের বক্তব্য আমরা শুনেছি। জয়শংকরের বক্তব্য সত্যি বিস্ময়কর। ঐ একই মানসিকতা যেটা রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে করছে।
চলমান এই যুদ্ধ ইতোমধ্যেই বহু হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইউক্রেনকে যুদ্ধের মাঠে রেখে পিছন থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ দিয়ে এই যুদ্ধে মার্কিন ও তার দোসরদের সরাসরি যু্ক্ত থাকার খবর যেমন আছে তেমনি যুদ্ধ বিরতির উদ্যোগের খবরও দিচ্ছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। জাতিসংঘে মস্কোর বিরুদ্ধের নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা যায়নি। রাশিয়া ভেটো দিয়েছে। এই প্রস্তাবে চীন ও ভারত ভোটদানে বিরত থেকেছে। নিন্দা প্রস্তাব প্রশ্নে ভারত ও চীন অভিন্ন অবস্থান নিল। যে কোন সংকটে শত্রু মিত্র নতুন ভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ রকম অপ্রয়োজনীয় একটি যুদ্ধ এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। আমরাও বিশ্ব বিবেকের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, "এই যুদ্ধ বন্ধ করো"।