সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসার অপেক্ষায়

উত্তর-পূর্ব ভারতের মনিপুরকে নিয়ে চলা নানান ঘটনার ভেতর থেকেই ভারতের লোকসভায় ২৮তম অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে বিরোধী দলসমূহ। অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করার মূল লক্ষ্য ছিল জোট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে মনিপুরের বিষয়ে বক্তব্য দাবি।
সাধারণত নরেন্দ্র মোদি সংসদে উপস্থিত থাকলেও কথা বলেন না। যে কারণে মনিপুর বিষয়ে বিরোধীরা তার বক্তব্য শুনতে চান, সেজন্যই বিরোধীদল এই অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন এনেছিল লোকসভায়।
দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিবেচনায় দুই কক্ষ মিলে প্রায় সাড়ে ৪০০ সদস্য রয়েছে বর্তমানে বিজেপি এবং তার জোটের। ভারতের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ৫৪৫ জন সদস্য আর রাজ্যসভায় ২০০ সদস্য। বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব ভোটে জয় লাভ করবে না, তা একরকম সুনিশ্চিতই ছিল। করেওনি। অনাস্থা ভোট ওঠার আগেই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রাহুল গান্ধীর মানহানির মামলার সাজা স্থগিত করেন। রাহুল গান্ধীর সদস্যপথ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করেছেন লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিজেপি তথা তার স্পিকারকে। মনিপুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও রাষ্ট্রের ও গণতন্ত্রের নানান দিক উঠে এসেছে বিরোধীদের আলোচনায়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল দিল্লি প্রশাসন-সংক্রান্ত এক নির্দেশের বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে খারিজ করার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন।
দিল্লির প্রশাসন কীভাবে পরিচালিত হবে, তা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এক নির্দেশে দিল্লির নির্বাচিত সরকারের ওপরে ন্যস্ত করেছিলেন। বর্তমানে দিল্লি শাসন করছেন আম আদমি পার্টির কেজরিওয়াল ও তার দল, বর্তমানে ভারতের বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার সমর্থক (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স)। সুপ্রিম কোর্টের সেই নির্দেশনাকে বাতিল করে দিয়ে লোকসভায় পুনরায় কেন্দ্রের কাছে ক্ষমতাটি রেখে দিয়েছে বিজেপি। এছাড়া অতীতে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে তা সুনিশ্চিত করেছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিল, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলের দলের নেতা মিলিতভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করবেন। কিন্তু বর্তমানে আরেকটি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি, যার মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনোনয়ন থেকে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপিত হতে যাচ্ছে।
এই অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বেশ কিছু দিক সামনে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কংগ্রেসের লোকসভার নেতা পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরীকে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর বক্তব্য না রাখার সুযোগ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার বক্তব্যে এ বিষয়টিকে উল্লেখ করে পশ্চিমবংগে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে অধীর চৌধুরীর দীর্ঘ বিরোধিতার কথাই উল্লেখ করেন। মোদি তার বক্তব্যে দেশটির শক্ত অর্থনৈতিক বুনিয়াদের কথা তুলে ধরেন। বর্তমানে পৃথিবীর পঞ্চম অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে ভারতের আবির্ভূত হওয়ার কথা বলেন তিনি। বিরোধী জোট ইন্ডিয়া সম্পর্কে বলা হয় যে এই জোটের সব নেতাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চায়।
নরেন্দ্র মোদি তার বক্তৃতায় সবসময় 'আমরা' শব্দটি ব্যবহার করেছেন দল ও জোটের কথা বলতে গিয়ে। কখনো 'আমি' শব্দটির ব্যবহার করেননি। যেমন পশ্চিমবঙ্গের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি তার বক্তৃতায় 'আমি' শব্দটির ব্যবহার করেন ব্যাপক। উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশেও রাজনৈতিক অঙ্গনে 'আমি' শব্দের ব্যবহার ব্যাপক। নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যে সব সময় 'আমি' শব্দটি শুনতে পাওয়া যায়।
যে মনিপুরকে নিয়ে এই অনাস্থা প্রস্তাব, সেই মনিপুরবিষয়ক সামান্য দু-একটি কথাই বলেছেন মোদি। তিনি স্পষ্ট করেননি যে ওই সংকটের পরিসমাপ্তি কীভাবে ঘটবে। মোদির বক্তব্য চলাকালে রাহুল লোকসভা ত্যাগ করেন রাহুল গান্ধী। মোদি তাকে উদ্দেশ করে বলেন, পালিয়ে যাচ্ছেন কেন?
নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য শেষে প্রস্তাবিত অনাস্থা প্রস্তাবটি সরাসরি খারিজ হয়ে যায় ভারতীয় লোকসভায়। তবে উত্থাপিত এই অনাস্থা প্রস্তাব বিরোধী রাজনৈতিক জোটকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কি না, তা এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। এই জোটের অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে কি না, সেটিও একটি প্রশ্ন। কারণ জোটের কিছু দলের মধ্যে আঞ্চলিক সংকট এত তীব্র যে ওই তীব্র সংকট নিয়ে আগামী দিনের এই জোট ওই রাজ্যগুলোতে নির্বাচনে পরস্পরের সহযোগী হতে পারে না। এই অবস্থা বিরাজ করছে সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গে।
পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও বিজেপিকে একত্রিত হতে দেখা যাচ্ছে। কোন কোন জেলা পরিষদ গঠন করার ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সিপিএম-বিজেপি যৌথভাবে, তা-ও গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এমনই সব রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর থেকেই ভারতে চলছে আগামী দিনের লোকসভা নির্বাচনের জোরালো প্রস্তুতি। উপমহাদেশের তিনটি দেশেই সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা কখন সৃষ্টি হবে কিংবা ফিরে আসবে, সে প্রশ্ন এখন সবচেয়ে বড়।