মোহম্মদ রফিকের সঙ্গে স্মৃতিচূর্ণ

ঢাকা ইউনিভিার্সিটির ছাত্রাবস্থায় আমি তখন মহসীন হলের একটা সিংগল রুমে থাকি। একদিন কবি মোহাম্মদ রফিক আমার রুমে চলে আসেন, সঙ্গে হোসেন সোহরাব। সে-ও একই হলে থাকে, কবিতা লেখে, যদিও ক্ষান্ত দিয়েছে এখন। আমার টেবিলের ওপরের তাকে রাখা বইপত্র নাড়াচাড়া করতে গিয়ে রফিক ভাইর চোখে পড়ে হাঙ্গেরীয় কবিতার ওপর একটা ইংরেজি প্রবন্ধের বই। সেটা তুলে নিয়ে বললেন, এটা নিয়ে যাচ্ছি, পরে ফেরত দেবো। ততদিনে কবিতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে এসেছে। বললাম, ফেরত দিতে হবে না, সম্প্রদান কারক অনুযায়ী দিচ্ছি আপনাকে। 'খোলা কবিতা' নামের দীর্ঘ কবিতাটি লেখা হয়নি তখনও। '...সব শালা কবি হবে ... একই চালে/ পায়ে, কালো বুট; হাতে, রাইফেলের উদ্যত সঙ্গীন/ এবার থামাও শালা। শুয়ারেরা ইয়ার্কি থামাও...।' সবারই জানা আছে, গোপন ছাপাখানায় নিউজপ্রিন্টে ছাপানো সেই কবিতা বিলি হয় তাঁরই ছাত্রছাত্রীদের হাতে। মারাত্মক সাহসী সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে দেশময়, ঘটে যায় তুমুল আলোড়ন। কুপিত হন ক্ষমতা দখলকারী প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তাঁকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় সেনা শিবিরে, স্বীকার করেন কবিতাটা তাঁরই রচনা, তবে কোন প্রেসে ছাপা হয়েছে, সেটি প্রকাশ করবেন না তিনি।
সেদিন মহসীন হল থেকে আমাকে বললেন, চলো, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। বিদেশি ছাত্র পড়াও বলে তোমার যোগাযোগ কেবল স্কটল্যান্ডের সঙ্গে। আজ স্বদেশের স্বাদ নাও ডাবের পানি দিয়ে। তারপর আমরা তিনজন একই রিকশায় চড়ে চলে আসি হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি পেরিয়ে এমপিতে (এই পরিভাষাটি সমঝদারদের জানা আছে)। বলা বাহুল্য, সেদিন রফিক ভাইর আমন্ত্রণের প্রতি সুবিচার করতে পারিনি।
আড্ডা দেওয়ার জন্য প্রায়ই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চলে আসতেন রফিক ভাই। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ একবার আবদার করল, তাঁকে তুই বলে ডাকবে। জাহাঙ্গীরনগরের ইংরেজির অধ্যাপককে রুদ্র তুই বলে ডাকবে! ভাবা যায়! তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। আরেকবার রুদ্রর সংগঠন রাখালের সঙ্গে লুঙ্গি পরে কোমরে গামছা বেঁধে কলা ভবনে মিছিলেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এ-ই হচ্ছেন 'গাওদিয়া'র কবি মোহম্মদ রফিক। নির্মলেন্দু গুণকে পুলিশে ধরা নিয়ে যেরকম গল্প চালু আছে, রফিক ভাইকে নিয়েও এরকম একটা গল্প শোনা যায়। একবার এমপি থেকে তাঁকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি কী করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষকতা করি। পুলিশ অবাক হয়ে বলে, শিক্ষকতা? কোথায়? রফিক ভাই অম্লান বদনে জানান, তিনি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের প্রধান। বলা বাহুল্য, এর পর পুলিশ লজ্জিত হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেফিরে কর্মসূত্রে যখন চট্টগ্রামবাসী, তখন মোহাম্মদ রফিক এসেছিলেন, সম্ভবত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। সে সময় আবুল মোমেন এবং শীলা মোমেন পরিচালিত সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছোটদের শিক্ষালয় 'ফুলকি'তে প্রায়ই নানান অনুষ্ঠান এবং আড্ডা হতো। সেসব আসরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হক কিংবা কবি শঙ্খ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বও কখনো উপস্থিত থেকেছেন। সেরকম আড্ডায় সেবার উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ রফিক। তিনি সদ্য আইওয়ার রাইটার্স ওয়ার্কশপ থেকে ঘুরে এসেছেন। (যদিও ক্লিনটন সিলি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আইওয়ার যে ওয়ার্কশপে জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটে, সেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ এবং বাংলাদেশের কবি মোহাম্মদ রফিকও অংশ নিয়েছিলেন। ক্লিনটন কি অন্য কারো কথা বলেছেন, নাকি মোহম্মদ রফিক আবারও আইওয়াতে গিয়েছিলেন, কিংবা সেবার আইওয়া থেকে ফিরে এসেছেন—আমার এই তথ্যটা ভুল। কেউ হয়তো সঠিক তথ্যটা দিতে পারবেন।)। সেবার চট্টগ্রামের আড্ডায় তিনি মার্কেস প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিজ্ঞতা থেকে (বাগেরহাটের আঞ্চলিক ভাষায়) বলেছিলেন, 'ওখানে মার্কেস কলি পর কেউ চিনতি পারবে না নে, গার্থিয়া মার্কেস কতি হবে।' তখনও মার্কেসের কিছুই পড়া ছিল না বলে, তাঁর কথাটা বেশ মনে আছে।
চট্টগ্রাম থেকে মুম্বাই ঘুরে আবার যখন ঢাকায় এসে থিতু হই, তখন রফিক ভাইর সঙ্গে দেখা হয়েছে কখনো কোনো অনুষ্ঠানে, প্রথম দেখায় একবারেই চিনে নিতে পেরেছিলেন। তাঁর সঙ্গে শেষবার দেখা হয় ঢাকায় বাতিঘরের এক অনুষ্ঠানে, ততদিনে তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয় প্রায় বিকল, একা চলাফেরা করতে পারেন না। অল্প কিছু স্মৃতিচারণ হলো। তারপর দীর্ঘদিনের অদর্শন। একসময় চলেই গেলেন চিরতরে। জীবনের শেষ দিকের একটা কবিতাতে মানুষের এই অন্তিম পরিণতির কথাই তো লিখে রেখেছেন তিনি:
'যে যা কিছু বলুক না/ যে গান বাঁধুক সাধু বাউল বা সুফি;/ দিনরাত্রি আবাস-নিবাস/ দায় ঠাঁই ঠিকানা-জিরাত/হিসাবপত্তর গোছগাছ করে রেখো/ কোথা থেকে এলে কিংবা যাবে বা কোথায়,/ সে প্রশ্ন উহ্য থেকে যাক, ক্ষতি নেই/ চড়তেই হবে বা চিতায়,/ হবে যদি গৃহকোণ অন্তিমে, মাটির/ আজরাইল বা যমদূত, খাংরাস্বরে/ জানতে চাইবে, জন্ম-নিবন্ধন কই/মাতা-পিতা নাম-ধাম জাতীয় আইডি;/ বিস্ময়ে বিহ্বল মিনমিন শব্দহীন শব্দে/ চাইতেও পারো বা জানতে; খোদ প্রভুও কি জানেন না,/ তুমি কে সে অভ্যাগত/ কোন বা অতিথি,/ অবশেষে এসেছো প্রাণের দ্বারে; তাই হে পথিক/ সাবধান, হিসাবে গরমিল যেন বা না ঘটে...।"
জানি না তাঁকে সমাহিত করার সময় কোনো প্রজাপতি এসে বসেছিল কি না তাঁর মরদেহের ওপর, কিন্তু সেটা কল্পনায় দেখে গিয়েছিলেন তিনি: 'লাশ নামানো হচ্ছে গোরে/ ঠিক সেই মুহূর্তে একটি প্রজাপতি/ কোত্থেকে, ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে উড়ে/ এসে বসল লাশের বুকের ওপর,/ প্রজাপতিটি নাড়াচ্ছে পাখনা;/ আনন্দে না বেদনায়/ কে বলবে!'