সরেজমিন পানপুঞ্জি

(বড়লেখা-কুলাউড়া থেকে ফিরে)
[সিলেটের পাহাড়ি-টিলায় গড়ে তোলা নিজেদের গ্রামকে 'পুঞ্জি' বলেন খাসি জনগোষ্ঠী। লতানো গাছপানসহ দেশীয় বৃক্ষপ্রজাতিতে ভরপুর থাকে বলে এসব বসত পানপুঞ্জি নামেও পরিচিত। পানপুঞ্জিগুলো আর আগের মতো থাকতে পারছে না। চাবাগান থেকে উপ-ইজারা নেয়া এসব পুঞ্জি থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে আদিবাসিন্দাদের। তাদের লাগানো বহু প্রাচীন বৃক্ষ ও পানগাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। জীবন ও জীবিকার ওপর এমন প্রশ্নহীন নিপীড়নের সুরাহা হচ্ছে না। সম্প্রতি আবারো মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও বড়লেখার বেশকিছু খাসিপুঞ্জি আক্রান্ত হয়েছে। বহিরাগতরা এসে পুঞ্জি দখল করেছে এবং নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলেছে। ক্ষতিগ্রস্থ পানপুঞ্জিগুলো পরিদর্শনের ভেতর দিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থের লেখা ও ছবিতে এই বিশেষ সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি হলো।]

১. কবর দিব কোথায়?
রেহানা চাবাগানের ভেতর দিয়ে চড়াইউৎরাই টিলাপথে পৌঁছতে হয় কাঁকড়াছড়া পানপুঞ্জিতে। পুঞ্জিতে যাওয়ার জন্য পুঞ্জিবাসীরা ছড়ার ওপর বাঁশ-ডাল দিয়ে একটি সাঁকো বানিয়েছেন। পুঞ্জিতে ঢোকার মুখেই একটা ছোট্ট খেলার মাঠ। বিষন্ন মুখে কয়েকটা বাচ্চা খুব সাবধানে একটা রংচটা ফুটবলে লাথি মারছে। মাঠটির চারদিকে লম্বা লাইন করে চা চারা লাগিয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ। বাচ্চারা ভয় নিয়ে খেলে, যেন চারা নষ্ট না হয়। মাঠটির চারপাশে গর্ত করে রাখা আরো চারার লাইন দেখা গেল। পুঞ্জিবাসীর ভয় অচিরেই হয়তো ৫০ শতক আয়তনের এই প্রাচীন খেলার মাঠ পুরোটি দখল করবে চাবাগান। পুঞ্জির প্রবীণ এডুইন মারলিয়া (৯০) কিংবা লেডিস লাকাচিয়াং (৫৫) জানান, আমরা নিজেরা এই মাঠে খেলেছি। গল্প শুনেছি বাবা নানারাও এই মাঠে খেলেছেন।
কেবল মাঠ নয়, কাঁকড়াছড়া পুঞ্জিতে গিয়ে দেখা গেল ২ একর আয়তনের একমাত্র কবরস্থানটিও দখল করেছে চা বাগান। খাসি ভাষায় এর নাম জিংত্যাপ, মান্দি ভাষায় মাংরুদাম। ২০১৩ সনের পর এই পুঞ্জিতে তিনজন মারা যান এবং তাদের সমাধি দিতে খুব সমস্যায় পরতে হয়। মাবিয়াং সুংঅ'র মৃত্যুর পরে কবর হারানোর বিষয়টি সামনে আসে। পানচাষী জন রুরামের (৫০) জানান, তার মা মেরানী রুরামের মৃত্যুর পর কোথাও কবরের জায়গা না পেয়ে চায়ের চারা তুলে মাকে সমাধি করতে বাধ্য হন তিনি। মৌলভীবাজারের কুলাউউড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের কাঁকড়াছড়া পানপুঞ্জিতে যখন এই জিংত্যাপ হারানোর কথা শুনছি তখন প্রায় সন্ধ্যা এবং মেঘে ছাওয়া আকাশ চারধারকে আরো অন্ধকার করে তুলেছিল। চারপাশে সব ক্ষুব্ধ বিষন্ন মুখের ভিড়। ভিড়ের ভেতর থেকে প্রবীণ মান্দি নারী বিনীতা রেমা (৭৫) বাংলায় চিৎকার করে বলেন, আমরা মরলে কবর দিতাম কই?
পুঞ্জির সবচে' প্রবীণ মানুষটিকে খুঁজে পেতে কষ্ট করতে হয় না। শতবর্ষী এই খাসি নারীর নাম কাকা লাকাচিয়াং। জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মসন লেখা আছে ১৯২১। তিনটি রাষ্ট্রের স্বাক্ষী হাসিমুখের এই মানুষটি মেলে ধরলেন সহস্র স্মৃতির পাতা। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় পাশ্ববর্তী আগারপুঞ্জির মতোই কাঁকড়াছড়া পুঞ্জিও গড়ে ওঠে। পাশের ছড়াটিতে প্রচুর কাঁকড়া পাওয়া যেত বলেই ছড়াটির নাম হয় কাঁকড়াছড়া। আর ছড়ার নামেই পুঞ্জির নাম। প্রথম পুঞ্জিপ্রধান ছিলেন ইয়াং খাসিয়া। তারপর একে একে দায়িত্ব নেন জনিস খাসিয়া, বন খংলা ও প্রভাত মারলিয়া। মুক্তিযুদ্ধের পর চাবাগানের মালিকানা বদল হয়। মোহাম্মদ রশিদ বাগান বেচে দেন, নতুন মালিক হন রেহানা বেগম। তারপর থেকে এই বাগান 'রেহানা চাবাগান' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। পানপুঞ্জিগুলো মূলত চাবাগান, বনবিভাগ বা খাসজমিতে গড়ে ওঠে। পাহাড়িটিলায় গড়ে তোলা নিজেদের গ্রামকে খাসি জনগোষ্ঠী 'পুঞ্জি' বলেন। পুঞ্জিপ্রধানকে বলেন 'মান্ত্রী'। রেহানা চাবাগানের সাথে কাঁকড়াছড়া পুঞ্জির ৯ বছর মেয়াদী একটি নতুন চুক্তি হয় ৫/৬/২০০৪ থেকে ৪/৫/২০১৩ পর্যন্ত। ২০০৪ থেকে পুঞ্জিপ্রধানের দায়িত্ব নেন জনপল চিসিম। জনপল জানান, ২০১৩ সনে রেহানা চাবাগানের সাথে পানপুঞ্জির চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও তারা আর চুক্তি নবায়ন করেনি। বছর বছর বাগান আমাদের গাছ কাটছে, পানজুম ধ্বংস করে চা বাগান সম্প্রসারণ করছে, এ কারণে পুঞ্জি থেকে অনেক পরিবার প্রতিবছর উচ্ছেদ হয়। সরেজমিনে জানা গেল, কাঁকড়াছড়াতে খাসি ও মান্দিদের ৪৭ পরিবার ছিল, বর্তমানে টিকে আছেন মাত্র ১৭ পরিবার।

কাঁকড়াছড়া ঘুরে পাহাড়ি টিলায় অনেক কাটা গাছের গুঁড়ি দেখা গেল। বেশ কিছু মাটির ঘর ভেঙেচুরে পড়ছে। এসব ঘর ফেলে নিরুদ্দেশ হয়েছেন অনেক পুঞ্জিবাসী। জানা গেল জন্মভিটা ছেড়ে যাওয়া এইসব মানুষেরা দীর্ঘদিনে গড়ে তুলেছিলেন এক সবুজ পানজুম। বিশালসব আম, জাম, কাঁঠাল, চাম্বল, বনাক, পুরখুং গাছ মেলেছিল ডালপালা। উড়ন্ত কাঠবিড়ালী, পাখি, মৌমাছি, সবুজ গাছ ব্যাঙ, বনরুই, খরগোশ গড়েছিল সংসার। চাবাগান সম্প্রসারণের নামে বছর বছর পানজুম ধ্বংস করার ফলে এসব বন্যপ্রাণী এখন কমে গেছে। খাসি নারী মেলোডি লাকাচিয়াং (৭০) জানান, চাবাগান বড় বড় সব গাছ কাটি, জংগলে সারাদিন খুঁজলেও আর তেতস্লাং (বুনো মাশরুম) বা সরং (বনডুমুর) মিলে না। গাছকাটা ও পানজুম ধ্বংসের ফলে কেবল পুঞ্জিবাসীর উচ্ছেদ বা বুনো খাবারের অভাব নয়, জীবিকা হারিয়ে অনেক পরিবার দিনমজুরে পরিণত হচ্ছে। টিলাজমিতে ২ একর জমি পেয়েছিলেন বিনীতা রেমার পরিবার। চাবাগান পানজুমের গাছ কেটে ফেলায় তার ছেলে মিন্টু রেমাকে এখন দিনমজুরি করতে হচ্ছে। দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিতে, তাও মার্চ-এপ্রিল কোনো কাজ পাওয়া যায় না।

মিন্টু রেমা যখন ধরা গলায় নিজের জুম হারানোর কথা বলছিলেন তখন রেলিস ছেল্লা ও রাবিয়া বেগমরাও তাদের জুম ধ্বংসের ঘটনা বর্ণনা করেন। কাঁকড়াছড়ার শিশু কী প্রবীণের মুখে হাসি নেই, সর্বদা এক উচ্ছেদ আতংক তাড়া করছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সদস্য ফাদার যোসেফ গোমেজ ওএমআই জানান, 'চাবোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর আড়াই শতাংশ নতুন বাগান সম্প্রসারণ করার কথা। আর চাবাগান সম্প্রসারণের এই নিয়মকে কব্জা করে বাগান কর্তৃপক্ষ পানপুঞ্জিগুলোর সাথে অন্যায় করেই যাচ্ছে। সরকার থেকে চাবাগান প্রথম জমি ইজারা নেয়, তারপর পানপুঞ্জির কাছে টাকার বিনিময়ে উপ-ইজারা দেয়। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে বাগান আর নবায়ন করতে চায় না। তারা প্রথমে পানপুঞ্জির সব বড় গাছ কেটে বিক্রি করে, সেখান থেকে একটা বড় আয় তাদের হয়।' সম্প্রতি পরিবেশকর্মী, গবেষক, শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মীদের একটি দল বড়লেখা ও কুলাউড়ার পানপুঞ্জি পরিদর্শন শেষে মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়ার কাছে কাঁকড়াছড়া পুঞ্জির প্রসঙ্গ তুলে ধরলে তিনি তৎক্ষনাৎ এ বিষয়ে যোগাযোগ করেন। প্রতিটি পানপুঞ্জির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রশাসন সদা তৎপর থাকবে এই আশ্বাস দেন।
২. খাসি ভাষায় 'উচ্ছেদ' বলে শব্দ নেই
'পানের রূপ লাবণ্য অথবা ভূমির রহস্য' নামে একটি গল্প আছে মৌলভীবাজারের আকমল হোসেন নিপুর। গল্পটিতে একটি প্রশ্ন রেখেছেন নিপু, 'পানজুন ধ্বংস হলে পাহাড় থেকে উচ্ছেদ হলে খাসি জনগোষ্ঠী খাবে কি, যাবে কোথায়? সিলেট বিভাগে গত ত্রিশ বছরে অনেক খাসি পানপুঞ্জি উচ্ছেদ হয়েছে। হবিগঞ্জের বৈরাগী, শীতলাপুঞ্জি থেকে শুরু করে শ্রীমঙ্গলের জানকীছড়া ও জোলেখা পুঞ্জি। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার জাপানপুঞ্জি, লাম্বাছড়া, সেগুনটিলা, ৫ নাম্বারপুঞ্জি। সেগুনটিলা ও ৫ নাম্বারপুঞ্জিতে মাত্র এক পরিবার টিকে আছে। বছর বছর উচ্ছেদ হলেও খাসিভাষায় 'উচ্ছেদ' বলে কোনো শব্দ নেই। এ বিষয়ে গবেষক সিলভানুস লামিন জানান, 'গ্রাম বা পুঞ্জি থেকে কাউকে তাড়ানো বা ভাগিয়ে দেয়াকে আমরা বলি 'বেহ ছোনং বা বেহ্ থাও বা পাকার', বসতি ছেড়ে যাওয়াকে বলি 'ফেট ছোনং'। কিন্তু এই যে পরিকল্পিতভাবে বলপূর্বক উচ্ছেদ এর কোনো খাসি শব্দ নেই। যে জনগোষ্ঠীর ভাষায় উচ্ছেদ বলে কোনো শব্দ নেই, জোর করে তাকে উচ্ছেদ করে তার ভাষায় এই শব্দ ঢুকিয়ে দেয়া কি ঠিক?' কেবল 'উচ্ছেদ' নয়, গত বিশ বছর ধরে অস্থানীয়রা যেভাবে জবরদখলের জন্য পানপুঞ্জির পানগাছ যেভাবে কাটছে এরও কোনো শব্দ নেই খাসি ভাষায়। পানজুমের ব্যবস্থাপনা হিসেবে লতানো পানের ডালপালা ছাঁটতে হয়, আবার কখনো উৎরাম রোগ হলে পুরো গাছ উপড়ে তুলে হয়। খাসি ভাষায় একে 'থাট পেথা' বা 'ফুট পেথা' বলে। কিন্তু জবরদখল ও উচ্ছেদের জন্য এলাপাথারি পান গাছ ধ্বংস করা পানজুম ব্যবস্থাপনার কোনো অংশ নয় আর তাই এভাবে 'পান গাছ কাটার' কোনো শব্দও খাসি ভাষায় নেই।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও কুলাউড়ার পানপুঞ্জি এলাকা পরিদর্শন করে জানা গেল ধারাবাহিক উচ্ছেদ ও পরিবেশ ধ্বংসের কাহিনী। মৌলভীবাজার জেলায় পানপুঞ্জি আছে প্রায় ৭৩টি। এর ভেতর কুলাউড়ায় ৩০টি, বড়লেখা ১৯টি, শ্রীমঙ্গলে ১২টি, কমলগঞ্জে ৬টি, জুড়িতে ৪টি ও রাজনগরে ২টি। পাহাড়ি টিলায় পানজুমসহ নিজেদের বসতকে খাসি জনগোষ্ঠী পুঞ্জি বলেন। খাসিদের পাশাপাশি এসব পুঞ্জির বাসিন্দা মান্দি, লালেং (পাত্র) ও কিছু বাঙালি পরিবার। বারবার উচ্ছেদ যেন পানপুঞ্জিবাসীর জীবন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড়লেখার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের ছোটলেখা চাবাগানের আগারপুঞ্জিতে বসবাস করছেন ৪৮ পরিবার। পাহাড়ে আগর গাছের বাগান থেকেই এই পুঞ্জির নাম হয়েছে আগার। জানা গেল এটি নতুন আগার পুঞ্জি এবং গড়ে ওঠেছে ১৯৯৮ সনে। প্রথম মান্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) ছিলেন কিলমিলাং পকর্ন। কিলমিলাংয়ের ছেলে কুইনসন আমসে (৬৪) জানান, ১৯৮০ সনে ইনাইনগর থেকে ৪০ পরিবার খাসিরা এসে প্রথম পুরান আগার পুঞ্জি গড়ে তুলেন। ১৯৯১ সনে চাবাগান গাছ কেটে সেই পুঞ্জিটি উচ্ছেদ করে এবং পুঞ্জিবাসীরা ঝিঙ্গেলা পুঞ্জিতে চলে যান। সেখানে থাকতে না পেরে পুরান আগারপুঞ্জির প্রায় এক কি.মি দূরে নতুন আগার পুঞ্জি গড়ে তুলেন।
সরেজমিনে দেখা গেল, পাহাড়ি টিলায় অবস্থিত আগার পুঞ্জির উত্তরে শাহবাজপুর চাবাগান, দক্ষিণে শ্রমিক বস্তি, পূর্বে বোবারথল ও পশ্চিমে ছোটলেখা চাবাগান। আলাপ হয় আগারপুঞ্জির প্রবীণ খাসি নারী স্তিবলি লামিনের সাথে। জীবেন পাঁচবার তাকে পুঞ্জি বদল করতে হয়েছে। জন্ম উগাছড়াতে, বিয়ের পর আলিয়াছড়া যান আলিয়াছড়া, তারপর দীর্ঘদিন বসবাস করেন পুরান আগারপুঞ্জিতে, উচ্ছেদ হয়ে যান ঝিঙ্গেলা পুঞ্জিতে এবং বর্তমানে বসবাস করছেন নতুন আগার পুঞ্জিতে। শংকিত স্তিবলি জানান, 'জানি না জীবনে আর কতদিন কতবার পুঞ্জি বদলানি লাগবো? আমরা কত কষ্ট কইরা গাছ বড় করি আর তারা কাটিয়া বিনাশ করে।'
২০২১ সনের ৩০ মে বহিরাগত দুর্বৃত্তরা আগার পুঞ্জির ১০০০ পান গাছ গোড়া থেকে কেটে ফেলে। নিহত পানগাছের স্তুপের কাছে যখন আমরা পৌঁছাই বোঝা যায় কী নৃশংসতা চলছে পানপুঞ্জি ঘিরে। গাছের শোকে পানজুমের মালিক রিনুস পডুয়েং ঠিকমত কথা বলতে পারছিলেন না। পুঞ্জিবাসীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, কেবল করোনাকালেই নয় এর আগেও পুঞ্জি দখলের জন্য দুর্বৃত্তরা তাদের গাছ ও পানজুম কেটে ফেলেছে। ২০১৯ সনের জানুয়ারিতে নালিখাই পুঞ্জির পান জুম ও বসতঘর পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২০১৫ সনের নভেম্বরেও আগার পুঞ্জির কয়েকশত পান গাছ কেটে বিনাশ করা হয়। ঘটনার পর পুঞ্জির মান্ত্রী সুখমন আমসে ৩১/৫/২০২১ তারিখে বড়লেখা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন (জিডি নং-১৪৯২)। সাম্প্রতিক এই পানজুম ধ্বংসের ঘটনায় এখনো অপরাধীকে সণাক্ত ও বিচার করা যায়নি।
সরেজমিনে জানা গেল, জবরদখল বা পানজুম ধংস নয়, উৎরামের মতো পানের এক ধরণের রোগের জন্যও অনেক সময় পুঞ্জি ছাড়তে হয় এখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের। পাশাপাশি জলবায়ু বিপর্যয় জনিত অনাবৃষ্টি এবং তীব্রতাপদাহ আজ আরেক সংকট হিসেবেও দেখা দিয়েছে। পানপুঞ্জির সুরক্ষায় সর্বস্তরের নাগরিক সংহতি গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে মৌলভীবাজারের জেষ্ঠ্য আইনজীবী ডাডলি পেরিক প্র্যান্টিস বলেন, 'এভাবে পানপুঞ্জিগুলো উচ্ছেদ হলে তা কেবল বাংলাদেশের জনমিতি বৈচিত্র্যকেই নষ্ট করবে না বরং একইসাথে পরিবেশ সুরক্ষার ভারসাম্যকেও বিনষ্ট করবে। কারণ পানপুঞ্জিগুলো বিশেষ পানজুম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ করে।' পানপুঞ্জি উচ্ছেদ, জবরদখল ও গাছকাটা প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক জনাব মীর নাহিদ আহসান জোর দিয়ে বলেছেন, পুঞ্জিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনজীবিকার সুরক্ষাই প্রশাসনের প্রথম অগ্রাধিকার।
আগারপুঞ্জিতে সিলেটের পানপুঞ্জি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ৪ পরিবার লালেং (পাত্র) নৃগোষ্ঠীও বসবাস করছেন। কথা হয় নির্মল পাত্র (৪৫) ও অধীর পাত্রের (৪৮) সাথে। সিলেটের মোকামপুঞ্জি থেকে ২০০৭ সনে তারা আগারপুঞ্জি আসেন। পানগাছ কাটার পর থেকে দিনেরাতে নিজেদের দেড় থেকে তিন হাজার পানগাছ পাহারা দিচ্ছেন। পানপুঞ্জির কোনো সংকটে সবাই সাধারনত খাসি ও মান্দিদের কথাই বলে, তারা সংখ্যায় কম বলে কেউ গুরুত্ব দেয় না। এমনকি তাদের বাচ্চারা লালেং ভাষা বলে না, শিখছে খাসি ভাষা। পুঞ্জি থেকে ফেরার সময় কাঁধের ঝোলা টান দিয়ে ছলছল চোখে বলেন, 'এইধারে গাছ কাটলে আমরা কই যাইতাম, কে আমরারে জাগা দিব?'

৩. গগণটিলা কি থাকবে?
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কালাপাহাড় বেগুনছড়া পুঞ্জিকে বলা হয় সিলেটের সর্বোচ্চ চূড়া। আর বড়লেখার সর্বোচ্চ চূড়া হলো গগণটিলা। ঐতিহাসিক পাথারিয়া পাহাড়ের অংশ এই গগণটিলাতেই প্রাচীন এক পানপুঞ্জি বনাখলা। গগণটিলাতে খাসি জনগোষ্ঠীর আদি বসত থাকলেও ২০০৭ সনে খাসিরা ছোটলেখা চাবাগান থেকে ২৭২ একর জমি ইজারা নিয়ে এই পুঞ্জি গড়ে তোলেন। ছোটলেখা চাবাগান সরকারের কাছ থেকে এক হাজার ৯৬৪ দশমিক ৫০ একর টিলাভূমি চাবাগানের জন্য ইজারা নিয়েছিল। চাবাগানের ইজারাকৃত জমি থেকেই কর্তৃপক্ষ টাকার বিনিময়ে খাসিদের উপ-ইজারা দেয়। সরেজিমন বনাখলা পুঞ্জিতে গিয়ে জানা যায়, ২০২১ সনের ২৮ মে বনাখলা পুঞ্জি দখল করে অস্থানীয় বাঙালিরা। বনাখলা পুঞ্জির মালকিন সুমের, সান্দাই পপ্লেক, আমস রূপসির, অলমি পতাম, স্টারসন নংরুত, স্টেরিং নংরুত, বেল বারেহ এবং সাইনিল পথমির প্রায় ৭০ একর পানজুম সাতদিন জবরদখল করে রাখে তারা। বনাখলার মান্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) নরা ধার (৫৫) জানান, 'জবরদখলকারীরা তার কাছে দশ লক্ষ টাকা দাবি করে এব উচ্ছেদের হুমকী দেয়। তারা পানজুমের পবিত্রতা নষ্ট করে ঘর ওঠায় এবং দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পুঞ্জিবাসীদের ভয় দেখায়।'
ঘটনার পর নরা ধার বড়লেখা থানায় একটি জিডি করেন এবং চাবাগান কর্তৃপক্ষ মামলা করে। পুঞ্জিবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পানপুঞ্জিতে গাছ কাটা, জবরদখল ও হামলা সাধারণ ধারাবাহিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এসব ঘটনার কোনো প্রতিকার নেই। কিন্তু বনাখলার সাম্প্রতিক ঘটনায় প্রশাসন বেশ তৎপর হয়েছে। জবরদখলের এক সপ্তাহের ভেতর বড়লেখা উপজেলা প্রশাসন ২০২১ সনের ৪ জুন বনাখলা পানপুঞ্জির জায়গা দখলমুক্ত করেছেন। বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলীর নেতৃত্বে পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে বনাখলা পুঞ্জিতে জবরদখলকারীদের নির্মিত ঘর উচ্ছেদ করেছেন।

বনাখলা পুঞ্জির মালকিন সুমের (৫৫) প্রায় বিশ বছর আগে আমছড়ি-বরমচাল পুঞ্জি থেকে বনাখলায় এসেছেন। তার ৬ একর জায়গা দখল করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছিল দখলকারীরা। বিধ্বস্ত সেই পানজুমে গিয়ে দেখা গেল দখলকারীরা বহু পান তুলে নিয়ে গেছে, জুমের ভেতর কলা গাছ কেটে ফেলেছে, বরুয়া বাঁশ কেটে নিয়ে গেছে। দখলকারীরা যেভাবে পানজুমে ঢুকেছে এবং নানা গাছলতা কেটেছে এতে সবাই শংকিত। কারণ খাসিরা খুব পবিত্র নিয়মে পানজুম করেন। আর এ কারণেই পানপুঞ্জির সামনে 'বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ' সাইনবোর্ড টানানো হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পানচাষী সান্দাই পপ্লেক (৪৮) জানান, 'আমরা গোসল করে পরিস্কার কাপড় পরে জুমে ঢুকি এবং বাইরের কাউকে ঢুকতে দেইনা, কারণ একবার যদি জুমে উৎরাম রোগ ছড়ায় তবে পুরা পুঞ্জি শেষ হয়ে যায়।'
পানপুঞ্জিগুলো কেবল পান ও ফলফলাদি উৎপাদন করে না, স্থানীয় বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কারণ লতানো পানচাষের জন্য দেশি প্রজাতির বহু প্রাচীন বৃক্ষ দরকার। এমন বহু দেশি গাছে লাইকেন, শৈবাল, ছত্রাক, ফার্ণ, অর্কিডও জন্মে। গাছগুলো যেন বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। পানপুঞ্জিগুলোতে অনেকের ঘরের সামনেই টিয়াপাখি দেখা যেত। কিন্তু সরেজমিন আগার, বনাখলা ও কাঁকড়াছড়া পুঞ্জিতে একটিও টিয়াপাখি চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে কাঁকড়াছড়া পুঞ্জির শতবর্ষী প্রবীণ খাসি নারী কাকা লাকাছিয়াং জানান, 'টিয়াপাখি থাকে বড় গাছের ক্রেমে (খোঁড়ল), সেখানে মৌমাছিও স্লিইঙাপ (চাক) বানায়। পুরনো বড় গাছ ছাড়া খোঁড়ল হয় না, চাবাগান বড় গাছ সব কেটে ফেলে, এখন পাখিও নাই, মৌমাছিও নাই।' কাকার বক্তব্যের সত্যতা মিলল পানপুঞ্জি ঘুরে খোঁড়লঅলা প্রবীণ বৃক্ষ খুব কমই পাওয়া গেল। আগারপুঞ্জির খাসি যুবকেরা জানাল, এখন বনে আর শিকার মেলে না, বছরবছর বড় গাছ কাটলে পানজুমের পরিবেশ ধ্বংস করলে বন্যপ্রাণীরাও উচ্ছেদ হয়ে চলে যায়। খাসি ভাষায় বনের মধুকে বলে 'আম ঙাপ'। আগারপুঞ্জির মান্ত্রী সুখমন আমসে জানান, তার পরিবার গত দুই বছর ধরে বন থেকে মধু সংগ্রহ করতে পারেনি। কারণ তরুল, বট, ডুমুর, চাম্বল গাছে চাক বেশি হয়, আর এসব গাছ বড় হলেই চাবাগান কেটে ফেলে। কুলাউড়ার কাঁকড়াছড়া পুঞ্জির মিন্টু রেমাদের প্রায় ১৪০টি ছেরেঙান (বনাক) ও ৬টি পুরখুং (জাউয়া) গাছ কেটেছে রেহানা চাবাগান। খাসিদের ভেতর আদি জেন্টিল ধর্মাবলম্বীদের কাছে এসব গাছ পবিত্র। 'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২' দেশের পবিত্র বৃক্ষ ও বন সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু আগার, কাঁকড়াছড়া ও বনাখলায় সরেজমিন দেখা গেল চাবাগান পানপুঞ্জির বহু পবিত্র গাছগুলোও কেটে ফেলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, 'সকল ধর্ম ও সংষ্কৃতির প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল আচরণ করার অঙ্গীকার আছে আমাদের সংবিধানে। কারো জীবনজীবিকাকে বিঘ্ন করে, কাউকে পেছনে ফেলে উচ্ছেদ করে কোনোভাবেই সকলের বাংলাদেশ সম্ভব নয়। পানপুঞ্জির জীবনজীবিকার নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্রকে সংবেদনশীল ও সজাগ হতে হবে।'

বাংলাদেশের খাসি, মান্দি, কোচ, লেঙাম জনগোষ্ঠীর মতো খুব মাতৃসূত্রীয় সমাজ টিকে আছে পৃথিবীতে। পানপুঞ্জি থেকে জানা গেল, এসব সমাজ শিশুদের পরিবেশ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে সকল মানুষের প্রতি সমমর্যাদার আচরণের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা বলেন, 'আদিবাসীদের প্রতি অন্যায় আচরণ নয় বরং তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তেলা জরুরি। চাবাগান সম্প্রসারণের নামে কোনোভাবেই কোনো পানপুঞ্জি ক্ষতিগ্রস্থ বা উচ্ছেদ করা যাবে না, চাবাগানের সাথে ইজারা বাতিল করে পানপুঞ্জির জন্য স্থায়ী ভূমি বন্দোবস্তের নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে।'

পানপুঞ্জির গাছ কাটা, উচ্ছেদ ও জবরদখল নিয়ে যখন ঘটনা ঘটছে তখন তৎপর হয়েছেন মাননীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এমপি। গত ১২ জুন বড়লেখার পানপুঞ্জি প্রধানদের সাথে মতবিনিময় করে পানপুঞ্জির উন্নয়ন ও নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন। এই সভার পর মোবাইলে কথা হয় কয়েকজন পুঞ্জিবাসীর সাথে। জানালেন তারা এখন আগের চেয়ে অনেক নিরাপদ বোধ করছেন। বললেন, সরকার চাইলে এই পাহাড়টিলায় আমরা থাকতে পারব। পানপুঞ্জির ঘটনা প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করছেন কুলাউড়ার সাংবাদিক মিন্টু দেশোয়ারা। কথাপ্রসঙ্গে জানান, প্রতিদিন বৃহত্তর সিলেট হারাচ্ছে তার টিলাভূমি। টিলাপাহাড় ও অরণ্যকে সাথে নিয়ে পানপুঞ্জিতে বাঁচার কায়দা রপ্ত করেছেন খাসি ও মান্দিরা। পানপুঞ্জিগুলো তাই আমাদের সম্পদ ও সংস্কৃতি হিসেবেই সংরক্ষণ করা জরুরি। আর এভাবেই টিকে থাকতে পারে গগণটিলার পরিবেশ।'
-
লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ