আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে এনসিপিকে যা যা করতে হবে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গতবছরে দেশব্যাপী ছাত্রদের নেতৃত্বে সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান– যা বদলে দিয়েছে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র, এমন প্রেক্ষাপটকে নিয়েই দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি।
দলে রয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের তরুণ ছাত্র নেতারা; আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন। অন্যান্য শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে আছেন হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, সামান্তা শারমিন প্রমুখ। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে দলের আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠানে নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে 'সেকেন্ড রিপাবলিক' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যাতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা করা যায়।
তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে, নির্বাচন কমিশনে থেকে অন্য দলগুলোর মতো সংসদীয় নির্বাচনের দল হিসেবে নিবন্ধন নিতে হবে এনসিপিকে। এজন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এ উল্লেখিত আইনি শর্তগুলোর একটি পূরণ করতে হবে। যারমধ্যে রয়েছে নির্বাচনি পারফরম্যান্সের মানদণ্ডে উৎরানো, শক্তিশালী একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি এবং দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চাকে নিশ্চিত করা।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর অধ্যায় ৬ (ক) এর ৯০খ (১) এ বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে আগ্রহী হলে নিম্নবর্ণিত তিনটি শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করতে হবে।
(অ) বাংলাদেশ স্বাধীন হইবার পর হইতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে। দলীয় নির্বাচনি প্রতীক লইয়া কমপক্ষে একটি আসন লাভ; বা
(আ) উপরি-উক্ত সংসদ নির্বাচনের যে কোনো একটিতে উক্ত দলের প্রার্থী কর্তৃক নির্বাচনে অংশগ্রহণকৃত আসনে প্রদত্ত মোট ভোটের শতকরা পাঁচ ভাগ ভোট লাভ; বা
(ই) কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় অফিস, উহা যে নামেই অভিহিত হউক না কেন, অন্যূন এক তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর] জেলা অফিস এবং অন্যূন একশতটি উপজেলা বা, ক্ষেত্রমত, মেট্রোপলিটন থানায়] অফিস প্রতিষ্ঠা যাহার প্রত্যেকটিতে সদস্য হিসেবে ন্যূনতম দুইশত ভোটারের তালিকাভুক্তি।
এদিকে সদ্য গঠিত হওয়ায়, এনসিপি আগের কোনো সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নেই। ফলে কোনো আসনেও তারা জেতেনি, বা শর্তমাফিক ভোটের শতকরা অংশ নিশ্চিত হয়নি।
সাংগঠনিক শর্তের ক্ষেত্রে, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলা ও একশ উপজেলা, মেট্রোপলিটন থানায় কার্যালয় থাকার শর্ত আছে।
নির্বাচনি পারফরম্যান্সের মানদণ্ড তাদের এই মুহূর্তে নেই জেনেই, এনসিপি শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো গড়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। দলের নেতারা কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে কাজ করার পাশাপাশি জেলা ও উপজেলায় দলের উপস্থিতি বাড়ানোর প্রচেষ্টা করছেন। এ শর্ত পূরণে দলটি রমজান মাসে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে।
দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার শর্তপূরণে এনসিপিকে যা যা করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে:
- কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে দলের সব পর্যায়ের কমিটির সদস্যদের দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত করাকে নিশ্চিত করা।
- দলের কমিটিগুলোর অন্তত ৩৩ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা, এবং
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা ছাত্র এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার কর্মচারী বা শ্রমিকদের [সমন্বয়ে] বা অন্য কোনো পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন না থাকা;
- সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা বা, ক্ষেত্রমত, জেলা কমিটির দলীয় সদস্যগণ কর্তৃক প্রস্তুত প্যানেল থেকে দলের কেন্দ্রীয় সংসদীয় বোর্ড কর্তৃক বিবেচনাপূর্বক প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করা।
এনসিপি ২১৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করলেও– কমিটির সব সদস্যরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন এটি নিশ্চিত করতে হবে।
দলীয় সংবিধানিক কাঠামোয় নারীদের ৩৩ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন না থাকার শর্ত পালন করতে হবে।
অভ্যন্তরীণ এসব নীতির সফল বাস্তবায়ন হবে নির্বাচন কমিশনের থেকে অনুমোদন লাভের জন্য অত্যাবশ্যক।
নির্বাচনি পারফরম্যান্সের শর্ত এই মুহূর্তে পূরণ করতে না পারায়, দলের নিবন্ধন পেতে প্রশাসনিক জেলাগুলোয় কার্যক্রম জোরদার করা দরকার এনসিপির। এ প্রক্রিয়ায় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার শর্তও মানতে হবে।
একইভাবে কেন্দ্রীয় কার্যালয়, জেলা বা থানা পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে ইসির নিবন্ধন পেতে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শর্তপূরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের প্রচলিত রাজনীতির ধারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে এনসিপির আবির্ভাব। সাংবিধানিক সংস্কার ও তরুণদের নেতৃত্বে রাজনীতির পক্ষে সোচ্চার হয়ে— দলটি এরমধ্যেই প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।
তবে আগে কখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণের ট্র্যাক রেকর্ড না থাকায়— দলটির আনুষ্ঠানিক বৈধতা লাভ নির্ভর করবে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তি তৈরিসহ কমিশনের অন্যান্য সব আইনি শর্ত পূরণের ওপর।
সফলভাবে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারলে, এনসিপি'র দেশে নতুন এক রাজনৈতিক বিকল্প হয়ে উঠে আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের শর্তপালনে ব্যর্থ হলে— আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীতার সক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হবে।
এসবের ভিত্তিতেই আগামী মাসগুলোয় নির্ধারিত হবে, আন্দোলন-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম থেকে জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের মতো কাঠামোগত রাজনৈতিক দলে এনসিপির উত্তরণ ঘটবে কিনা।