এনসিপি-র ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ কী? অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কী চায়?

গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ঘোষণাপত্রে সেকেন্ড রিপাবলিক বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এর আগেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত বছরের ২২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এই দাবি জানায়। কিন্তু দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো রাজি না হওয়ায় তখন সেই আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
নতুন রাজনৈতিক দলটির এমন ঘোষণার প্রেক্ষাপটে সেকেন্ড রিপাবলিক আসলে কী এবং এটি কীভাবে কাজ করবে, তা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
সেকেন্ড রিপাবলিক কী?
শুক্রবার এনসিপির আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠানে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'আমরা মনে করি জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে। …আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে।'
সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা একটা রিপাবলিক পেয়েছি। কিন্তু সেটা যেহেতু জনগণের আকাঙ্ক্ষার নিকট অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, তাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ আমূল পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে আছে। এজন্য রাষ্ট্রীয় সংবিধান বিলোপ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে হবে। আর সেটাই হবে সেকেন্ড রিপাবলিক।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রথম রিপাবলিক যদি ফাংশন করত, তাহলে এখন এই দাবির প্রাসঙ্গিকতা থাকত না। আমি মনে করি, সেকেন্ড রিপাবলিক হওয়া উচিত, কারণ নতুন-পুরানোদের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এটাই কার্ল মার্ক্স আমাদের বলে গেছেন।'
দিলারা চৌধুরী বলেছেন, দ্বিতীয় রিপাবলিক ঘোষণার সবচেয়ে নিকট উদাহরণ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ারই আরেক দেশ নেপালে। সেখানে ৬টি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণা হয়েছিল। এছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে বিভিন্ন সময় সেকেন্ড, থার্ড রিপাবলিকের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ফ্রান্সে এখন পঞ্চম রিপাবলিক ব্যবস্থায় সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ টিবিএসকে বলেন, 'এই দাবিটি তারা স্পষ্ট করতে পারেনি। ১৯৭১ সালে তো একটা রিপাবলিক ঘোষণা হয়েছিল। সে সময় এটার কোন বিকল্প ছিলোনা। আর সেটাই এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি। তাছাড়া এখনও '৭২-এর সংবিধান তো বাতিল হয়নি।'
তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন করে কিংবা মূলনীতিতে সংযোজন এনেও সংকট মোকাবিলা করা যায়। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সব রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বৈধতা তো পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে দিতেই হবে, যেটা জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ করেছিলেন। এজন্য সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণা করা মুখ্য বিষয় না।
মহিউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, 'গত ছয় মাসে ছাত্ররা সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে বিস্তারিত কিছুই জানাতে পারেনি। আর অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে একমত হয়নি। এমনকি তারা কিয়ামতের আগেও কোনো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে না। তাই সেকেন্ড রিপাবলিকের ভবিষ্যত কী হবে, তা বলা যাচ্ছেনা।'
তবে মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে দিলারা চৌধুরী বলেন, 'তত্ত্বীয়ভাবে এটা সম্ভব। কিন্তু এই সংবিধান বাতিল করে বিপ্লবী সরকার গঠনের মাধ্যমে প্রোক্লেমেশন করতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য দরকার। সংবিধান সংশোধন করলে সেটা সম্ভব না। অনেকেই '৭২-এর সংবিধান আঁকড়ে থাকতে চায়, যদিও সেটা অগণতান্ত্রিক এবং ফ্যাসিবাদ তৈরির অনুঘটক ছিল।'
ছাত্রদের প্রস্তাবনা কী?
এর আগে গত নভেম্বরে ছাত্রদের পক্ষ থেকে সেকেন্ড রিপাবলিকের রূপরেখা প্রণয়নে 'অল পার্টি কাউন্সিল' গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। যদিও এ ব্যাপারে অন্যান্য রাজনৈতিক দল আগ্রহ দেখায়নি।
সে সময় ২৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রোক্লেমেশন অভ সেকেন্ড রিপাবলিক সম্পর্কে টিবিএসের এক প্রশ্নের উত্তরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেছিলেন, 'প্রক্লেমেশন ঘোষণা হলে সবকিছু বাতিল হয়ে যাবে, সেটি সত্য নয়। যেমনটি স্বাধীনতার ঘোষণা রেট্রস্পেকটিভ ছিলো—যা ১০ এপ্রিল দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটি ২৫ মার্চের পর থেকে বহাল ছিল। একইভাবে আমাদের প্রোক্লেমেশন ৫ আগস্ট থেকে শুরু হবে। অর্থাৎ ৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় আমাদের যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ হয়েছে, সেগুলো এই প্রোক্লেমেশনের আওতায় চলে আসবে। সেক্ষেত্রে আর কোনো জটিলতা থাকবে না।'
রূপরেখা কে ঘোষণা করবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আমরা যদি সেকেন্ড রিপাবলিকের রূপরেখা দিয়ে দিই, তাহলে গণঅভ্যুত্থাণের আকাঙ্ক্ষাকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করবে না। গণঅভ্যুত্থানের আরও অনেক অংশীদার আছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন আছে, তেমনি ছাত্র-জনতাও আছে।'
আরিফ সোহেল বলেন, 'সব গোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময় করে রূপরেখাটি প্রস্তুত করতে হবে। তাহলেই সেটি গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরবে। এজন্য আমরা বলেছি, সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে "অল পার্টি কাউন্সিল" গঠন করা হোক। সেটির সাথে আলাপ-আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করবে। সেইসাথে অল পার্টি কাউন্সিল সেকেন্ড রিপাবলিকের রূপরেখাটি তৈরি করবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতেই হবে। এই সরকার নির্দলীয় হওয়াতে তার কাছে রাজনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনার কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রধান স্টেকহোল্ডার ভাবার সুযোগ নেই।'
ছাত্রদের সেকেন্ড রিপাবলিকের দাবিতে ভিন্নমত রাজনৈতিক দলগুলোর
গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের বিষয়ে ছাত্র প্রতিনিধিরা দেশের ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে। এতে বিএনপিসহ ২৬টি দল সাংবিধানিক জটিলতার কারণে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ ৪টি দল ছাত্রদের দাবির প্রতি নীতিগত সমর্থন জানায়।
সে সময় ৮ অক্টোবর সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয়ে রিপোর্টাস ইউনিটিতে এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি, অন্তর্বতী সরকারের ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। তাই নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। হুটহাট সংস্কার ও আবেগবশত কোনো সিদ্ধান্ত নিলে রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা যাবে না। দেশ গভীর সংকটে পড়বে।'
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সহকারী সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, 'একটা কথা বুঝতে হবে, গণঅভ্যুত্থান কোনো আইন মেনে হয় না। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করতে আবার আইন দরকার। ফলে একদিকে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে হবে। আবার গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য কাজ করতে এমন পদ্ধতি নিতে হবে যেন ফ্যাসিবাদ আসতে না পারে। ফলে এমন কোনো পথ আমরা এখনই নিতে চাই না বা পারি না, যা নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের পথ খুলে দিতে পারে। তাই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সাধারণ ঐকমত্য তৈরি করা উচিত, যাতে ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণে রোডম্যাপ তৈরি হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন অন্তর্বর্তীকালীন ভূমিকাতেই থাকে।'
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ, সেকেন্ড রিপাবলিকসহ ছাত্রদের পাঁচটি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার বলেছিলেন, 'আমরা পরিষ্কার বলেছি যে বাংলাদেশে সংবিধানের কথা বলে রাষ্ট্রের সংকট জিইয়ে রাখা হয়েছে। এই সংবিধানের অজুহাত দেওয়া উচিত নয়। কারণ গণঅভ্যুত্থাণ সংবিধান মেনে হয়নি, উপদেষ্টা পরিষদ সংবিধান মেনে হয়নি। ফলে আমরা উপদেষ্টা পরিষদকে বলব, জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে আমরা যেমন সরকার গঠন করেছি, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে বিদায় করেছি, তেমনি রাষ্ট্রপতি ইস্যুকেও আমরা সমাধান করতে চাই।'
রাজনৈতিক দলগুলো কেন ছাত্রদের দাবিকে সমর্থন দিচ্ছে না, এমন প্রশ্নের উত্তরে দিলারা চৌধুরী বলেন, 'তারা মূলত অচিরেই নির্বাচন করে পুরানো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়। এমনটি হলে '২৪-এর অভ্যুত্থানের গুরুত্ব রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকবে না।'