তাজমহল দেখার স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হলো বাদলের: যাবজ্জীবন ভারতের তিহার জেলে, দেশে এসেও বন্দি

অতিরিক্ত তিন বছর কারাভোগের পরও মুক্তি মিলছে না ভারতে বেড়াতে গিয়ে খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া বাংলাদেশি তরুণ বাদল ফরাজির। ছেলের শোকে মারা গেছেন বাবা, বৃদ্ধ মা এখন শয্যাশায়ী। ছেলেকে দেখতে আসতে পারেন না কারাগারে। মৃত্যুর আগে ছেলের মুখ দেখে যেতে চান তিনি। কিন্তু সেই মুক্তি কবে মিলবে, তা বলতে পারছেন না কেউ।
হতভাগ্য বাংলাদেশি যুবক বাদল ফরাজির বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের কাছে মোর্শেদ সড়ক এলাকায়। তিনি মৃত আবদুল খালেক ফরাজির ছেলে। তার মা শেফালি বেগম। তারা পাঁচ ভাই-বোন।
২০০৮ সালের ১৩ জুলাই বাদল ফরাজি আগ্রার তাজমহল দেখার জন্য বৈধভাবে ভারতে যাওয়ার পরেই বিএসএফ তাকে ভারতীয় নাগরিক বাদল সিং মনে করে আটক করে। পরে বাদল ভারতে প্রবেশের আগেই ২০০৮ সালের ৬ মে দিল্লিতে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে ভারতের একটি আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
কারাদণ্ড শেষ হলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে তাকে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। নির্দোষ বাদল ফরাজি বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছেন।
বাদল ফরাজির বোন আকলিমা খাতুন বলেন, 'আমার ভাই বিনাদোষে যাবজ্জীবন সাজা ভোগের পরও তিন বছর পার হয়ে গেছে, এখনো মুক্তি পাচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার ভাইয়ের চিন্তায় আমার বাবা মারা গেছেন। আমার মাও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। মায়ের শেষ ইচ্ছা, মৃত্যুর আগে ছেলের মুখ দেখে যেতে চান। আমরা আশা করি, সরকার আমার নিরপরাধ ভাইয়ের মুক্তির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।'
আকলিমা জানান, বাদল ফরাজিকে কাশিমপুর কারাগারে আনার পর ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর সর্বশেষ ভাইয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি বলেন, 'তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ভাইয়ের মুক্তির জন্য লিখিত আবেদন জানালে তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, আমার নিরপরাধ ভাইকে দ্রুত মুক্তি দেওয়া হোক।'
কারাগার সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নাফিসা আরেফিন কারাগার পরিদর্শনের সময় বাদল ফরাজির বিষয়টি তার নজরে আসে। তিনি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন এবং তার মুক্তির বিষয়ে নির্বাহী আদেশ প্রদানের অনুরোধ জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাদল ফরাজি দেশে থাকার সময় অষ্টম শ্রেণি পাস করে বাবার সঙ্গে মেকানিকের কাজ করতেন। আগ্রার তাজমহল দেখার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। বৈধ পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশের পরই বিএসএফ তাকে আটক করে।
সূত্র আরও জানায়, বাদল ফরাজি ভারতে প্রবেশ করার আগেই ২০০৮ সালের ৬ মে দিল্লির অমর কলোনিতে এক বৃদ্ধাকে খুন করে তার বাসার দুই কাজের লোক। তাদের একজনের নাম বাদল সিং। সেই বাদল সিংকে ধরতে ভারতীয় পুলিশ সতর্কতা জারি করে। বাংলাদেশ থেকে ইমিগ্রেশন শেষে ভারতে প্রবেশের পর বিএসএফ তাকে বাদল সিং মনে করে আটক করে ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
পরে ওই খুনের অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় বাংলাদেশের নিরপরাধ যুবক বাদল ফরাজিকে ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট দিল্লির সাকেত আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। তারপর তাকে নেওয়া হয় ভারতের তিহার কারাগারে। দিল্লি হাইকোর্টে আপিল করা হলেও নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকে।
তিহার কারাগারে বন্দি থাকার সময় ভারতের মানবাধিকারকর্মী রাহুল কাপুরের সঙ্গে পরিচয় হয় বাদল ফরাজির। তিনি বিষয়টি বাংলাদেশ হাইকমিশনকে জানালে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়।
প্রায় ১০ বছর ৭ মাস ভারতে কারাবাসের পর বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় ২০১৮ সালের ৭ জুলাই বাদল ফরাজিকে দেশে এনে প্রথমে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। পরে ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এ স্থানান্তর করা হয়।
কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, 'ভারতীয় পেনাল কোড অনুযায়ী যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ ১৪ বছর। এ হিসাবে বাদলের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ২০ জুলাই। তারপরও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে তিন বছর অতিরিক্ত কারাভোগ করছেন তিনি।'
সূত্র জানায়, বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে মুক্তি দিতে হলে রায় ঘোষণাকারী আদালতের অনুমোদন নিতে হয়। এ কারণে বাদল ফরাজির সাজার মেয়াদ শেষে ২০২২ সালের আগস্টের পর থেকে ভারতীয় সরকারের অনুমোদনের জন্য অন্তত পাঁচবার চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ভারত থেকে কোনো উত্তর আসেনি। ফলে বিনা অপরাধে সাজা ভোগ করার পরও বাদল ফরাজিকে আরও তিন বছর অতিরিক্ত কারাভোগ করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এর সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'বাদল ফরাজি আমাদের এখানে আসার পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টি জানতে পারেন এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। আমরাও চিঠি দিয়েছি। সরকারের নির্দেশনা পেলেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'