‘শয়তানের নিঃশ্বাস’: ঢাকায় কি সত্যিই আছে ‘বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর মাদক’?

বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট। ব্যস্ত পান্থপথ সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুহাম্মদ আফজাল। গন্তব্য কারওয়ান বাজার। তবে মাঝপথে সিএনজি অটোরিকশা বিকল হয়ে যাওয়ায় তিনি অন্য গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ঠিক সে সময়, মুখ ঢেকে রাখা এক ব্যক্তি তার কাছে এসে হাতে ময়লা একটি কাগজ দেখিয়ে সাহায্য চাওয়ার ভঙ্গি করেন। পথচারীরা আফজালকে সতর্ক করে দেন—এই ব্যক্তি হয়ত তাকে কোনো মাদক খাইয়ে দিতে পারে।
কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমাগমের মাঝে কেউ কীভাবে অপরিচিত ব্যক্তির ওপর মাদক ব্যবহার করতে পারে?
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, এক ব্যক্তি অপরের সামনে কাগজ ধরে কিছু বলতে যান, এরপর হঠাৎ করে মুখের সামনে কিছু ফুঁকে দেন। এতে ভুক্তভোগী একপ্রকার সম্মোহিত অবস্থায় নিজের মূল্যবান সামগ্রী তুলে দেন।
কী এই 'শয়তানের নিঃশ্বাস'?
ধারণা করা হচ্ছে, এ ধরনের অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে 'শয়তানের নিঃশ্বাস' নামে পরিচিত এক মাদক। একে বিশ্বের 'সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাদক' হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
'শয়তানের নিঃশ্বাস' মূলত কলম্বিয়ার স্থানীয় উদ্ভিদ বোরাচেরো'র ফুল থেকে তৈরি হয়। এ পদার্থটির রাসায়নিক নাম স্কোপোলামিন বা হায়োসিন। এটি কিছু দেশে চিকিৎসার জন্য প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, স্কোপোলামিনের প্রভাবে কেউ ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় অজ্ঞান থাকতে পারেন। কলম্বিয়ায় এই মাদকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি বলে জানা যায়। দেশটিতে প্রতি বছর আনুমানিক ৫০ হাজার মানুষ এ ধরনের ঘটনার শিকার হন।
উচ্চ মাত্রায় গ্রহণ করলে এটি 'শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে দিতে পারে, যা মৃত্যুর কারণও' হতে পারে। তবে এমন প্রভাবের জন্য এই মাদক তরল বা গুঁড়ো আকারে খাদ্য ও পানীয়ের সঙ্গে মিশিয়ে মুখ দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। সরাসরি মুখের সামনে ফুঁকে দেওয়ার মাধ্যমে এর এত তীব্র প্রভাব পড়ার বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়।
বাংলাদেশে এল কীভাবে?
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে 'শয়তানের নিঃশ্বাস' উদ্ধার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই মাদক বিক্রি করছিলেন।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে ১০ গ্রাম স্কোপোলামিন, ১ দশমিক ২ লিটার পটাসিয়াম সায়ানাইড, ২ দশমিক ৫ লিটার ক্লোরোফর্ম, ছয়টি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ এবং একটি রেজিস্টার বই উদ্ধার করা হয়।
এর আগে, ২০২৩ সালের আগস্টে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রাস্তার পাশে নর্দান ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষকের মরদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়েই পুলিশ এই মাদক উদ্ধার করে।
সে সময় নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, 'আমরা বিভিন্ন সময় ক্রিস্টাল মেথসহ নানা মাদক দেখেছি, তবে এই নামটি নতুন। আমিও প্রথমবার শুনেছি এবং পরে এ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। এই মাদক এত শক্তিশালী যে, কেউ এটি গ্রহণ করলে কয়েক ঘণ্টার জন্য স্বাভাবিক চেতনাশক্তি ও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।'
আতঙ্ক কতটা বাস্তব?
আফজাল ঘটনার পর বাড়ি ফিরে 'শয়তানের নিঃশ্বাস' নিয়ে খোঁজখবর নেন এবং যারা তাকে সতর্ক করেছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তবে তার মনে প্রশ্ন থেকে যায়—এমন পরিস্থিতির শিকার হলে তিনি কি যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবেন?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, 'শয়তানের নিঃশ্বাস' নিয়ে ছড়ানো আতঙ্ক অনেকাংশেই অতিরঞ্জিত।
২০১৫ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (ইউসিএল) ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি ইউনিটের অধ্যাপক ভ্যাল কারান বলেছিলেন, 'এ ধরনের আতঙ্কজনক গল্প শোনা যায়। কিন্তু কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন।'
ব্রিটিশ রসায়নবিদ ও সাবেক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ড. লেস কিং জানান, 'কারও মুখে গুঁড়া ফুঁকে দিয়ে সম্মোহিত করাটা বাস্তবে খুবই অস্বাভাবিক। এটি বিজ্ঞানসম্মত নয়।'
ঢাকায় এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়ালেও এমন ঘটনার কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড নেই।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'শয়তানের নিঃশ্বাস' ব্যবহার করে সংঘটিত কোনো অপরাধের অভিযোগ থানায় এখন পর্যন্ত দায়ের হয়নি।
মোহাম্মদপুর, হাতিরঝিল ও তেজগাঁও থানার অন্যান্য কর্মকর্তারাও জানান, এ বিষয়ে তাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি।
তবে গুজব থেমে নেই। ২০২১ সালে হংকংয়ে একই ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। অনেকেই অভিযোগ করেছিলেন যে, মুখে কিছু ফুঁকে দেওয়ার পর তারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং পরে দেখেন, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হয়ে গেছে।