জনপ্রশাসনের খোলনলচে সংস্কারে আজ প্রতিবেদন জমা দেবে কমিশন

জনপ্রশাসন সংস্কারে আগের কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন না হলেও, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুরো জন প্রশাসনের খোলনলচে বদলে (আমূল পরিবর্তন) দিতে শতাধিক সুপারিশ করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। আজ (৫ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবেন তারা।
কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী গতকাল মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, "প্রতিবেদনে ১০০টির বেশি সুপারিশ থাকছে এবং সবগুলোই বাস্তবায়নযোগ্য। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি না, সেটা সরকার বুঝবে।"
কমিশনের সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কমাতে 'সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস' (এসইএস) নামে নতুন একটি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব থাকছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। সরকারের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা এই সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। এই সার্ভিস থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিবসহ মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সচিব নিয়োগ দেওয়া হবে।
সকল ক্যাডারের কর্মকর্তারা সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তির জন্য পরীক্ষা দিতে পারবেন। উত্তীর্ণ কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০% এবং অন্যান্য ক্যাডার থেকে ৫০% পদ পূরণ করা হবে।
প্রতিবেদনটি গত মাসে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও মাঠপর্যায়ের কাজ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের আলোচনা এবং অনলাইন ফিডব্যাক সংগ্রহে দেরি হওয়ায় এ বিলম্বিত হয়েছে বলে জানান মুয়ীদ চৌধুরী।
তিনি বইলেন, "এই ইনপুটের ওপর ভিত্তি করে এটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।"
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেসুর রহমান জানান, প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার পর তা প্রকাশ করা হবে এবং এটি অনলাইনে পাওয়া যাবে।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর তা প্রকাশ করা হবে বলে জানান তিনি। প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তরের আগে সুপারিশের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি এই কর্মকর্তা।

মূল সুপারিশসমূহ
বর্তমানে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ এবং অন্যসব ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমিয়ে ৫০ শতাংশ করে অন্যসব ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ করার চিন্তা করেছিল। কমিশন এই ভাবনা নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর এ নিয়ে আন্তক্যাডার দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যাওয়ায় সেই অবস্থান থেকে সরে এসে পরীক্ষা পদ্ধতির সুপারিশ করছে কমিশন।
এছাড়া, বিভাগীয় কমিশনারকে প্রশাসন ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ হিসেবে রাখার প্রস্তাব করতে যাচ্ছে সংস্কার কমিশন। সমবায় ও খাদ্য ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত করারও পরামর্শ করবে তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কৃষি ক্যাডারের মতো বিশেষায়িত ক্যাডারের জন্য আলাদা সার্ভিস কমিশন গঠনের প্রস্তাব করবে কমিশন। কারিগরি ক্যাডারগুলোকে নিয়ে প্রকৌশল সার্ভিস এবং বিশেষায়িত ক্যাডারগুলোর জন্য আলাদা আলাদা সার্ভিসের প্রস্তাব করা হতে পারে।
স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে এই দুই খাতে ক্যাডার, নন-ক্যাডারসহ সব ধরনের নিয়োগের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করবে কমিশন।
এছাড়া, সরকারি কর্মচারীদের জন্য, বর্তমানে পেনশন সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসর নিতে ২৫ বছরের চাকরি করা প্রয়োজন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এই শর্ত কমিয়ে ১৫ বছর করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ করার পাশাপাশি বিদ্যমান আটটি প্রশাসনিক বিভাগের বাইরে কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি নতুন বিভাগ করার প্রস্তাব করতে যাচ্ছে কমিশন।
কমিশন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের সংখ্যা বর্তমান ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ করার সুপারিশ করবে। কমিশন এক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানে ডেপুটেশনে কাজ করার অনুমতি না দেওয়ার সুপারিশও করতে পারে।
জেলা পরিষদ বিলুপ্ত করে উপজেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করার সুপারিশ করতে পারে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সংস্কার কমিশনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জেলা প্রশাসকদের কার্যালয় এবং জেলা পরিষদ নিজেদের কাজে সহযোগিতা ও সমন্বয় না থাকায় কমিশন এই সুপারিশ করার চিন্তা করছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গত ৩ অক্টোবর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও কাজ শেষ না হওয়ায় দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়।
সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন এবং পুলিশ সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আজ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিলে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদন জমা হবে।
সংস্কার কমিশনগুলোর প্রধানদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন করবে সরকার। এই কমিশন রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে সেগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবায়নের সুপারিশ করবে।