বাজার সৃষ্টির অভাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক শিল্প

বায়ু দূষণ রোধ, কৃষিজমি রক্ষাসহ অন্যান্য দূষণ রোধে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক বা ব্লক ইটের ব্যবহারকে বহুদিন ধরেই উৎসাহিত করে আসছে সরকার। তবে রাজনৈতিক প্রভাব, অবৈধ ইট ভাটার দৌরাত্ম ও বাজার সৃষ্টি করতে না পারায় আশানুরূপভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে না পরিবেশবান্ধব এই ব্লক ইট শিল্প।
বেসরকারি উদ্যোগে সম্প্রসারণের চেষ্টা ছাড়াও ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি কাজে শতভাগ ব্লক ইটের ব্যবহার নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। তবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ এখন অনেকটাই কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস ডিভিশনের সিনিয়র রিসার্চ অফিসার আহসান হাবিব টিবিএসকে বলেন, "আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, প্রযুক্তিগত সহায়তাও দিচ্ছি।"
তিনি বলেন, "কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রতিটি ইট ভাটা পরিচালনার ক্ষেত্রে, পাশেই সমান-ক্ষমতাসম্পন্ন ব্লক ইটের কারখানা নির্মাণের সরকারি নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তা অনুসরণ করা হয় না। এছাড়া, সরকারি কাজের দরপত্রের নথির শর্তে ব্লক ইট ব্যবহারের বিষয়টি বাধ্যতামূলক থাকতে হবে।"
অর্থ বছরভিত্তিক পোড়া ইটের পরিবর্তে ব্লক ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল— ২০১৯-২০ অর্থবছরের মধ্যে সরকারি নির্মাণ কাজের ১০ শতাংশ; ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যে ২০ শতাংশ; ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে ৩০ শতাংশ; ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে ৬০ শতাংশ; ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে ৮০ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে ১০০ শতাংশ ব্লক ইট ব্যবহার করা।
কিন্তু এর অগ্রগতি নেই বললেই চলে। কতটুকু হয়েছে অগ্রগতি, এরও হিসাব নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে। বর্তমানে, পোড়ানো ইটের তুলনায় ব্লক ইটের উৎপাদন মাত্র ৬-৭ শতাংশ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) ড. মোহাম্মাদ আব্দুল মোতালিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কোভিড মহামারিসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে কিছুটা ধীর গতি ছিল। সরকারি সংস্থাগুলোতেও ব্লক ইটের ব্যবহার বাড়ছে। তবে কত শতাংশ হচ্ছে, তা জানা নেই। একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সমীক্ষা করার। মাস ছয়েক পরে তা জানা যাবে।"
একইসঙ্গে, ২০২৫ সালের মধ্যে অগ্রগতি ভালো হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।
বাজার সৃষ্টিই বড় প্রতিবন্ধকতা
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত ব্লক ইটের কারখানার সংখ্যা ১৬৪টি। এসব কারখানায় বছরে ২১৪ কোটির মতো ব্লক ইট উৎপাদিত হয়।
তবে এর বাইরেও অনিবন্ধিত আরো ছোট ছোট কারখানা রয়েছে। সবমিলে আড়াই শতাধিক ব্লক ইটের কারখানা রয়েছে সারাদেশে— যার উৎপাদন ক্ষমতা পোড়ানোর ইটের তুলনায় মাত্র ৬-৭ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি প্রজ্ঞাপন কাগজে কলমে রয়ে গেছে; তা বাস্তবায়ন হয়নি। আর বাজার সৃষ্টি না হলে কারখানা বাড়বে না। পরিবেশ বিধ্বংসী পোড়ানো ইটের কারখানা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে ইট ভাটার সংখ্যা ৮ হাজারেও বেশি বলা হলেও আদতে তা ১০ হাজার হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ কংক্রিট ব্লক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি লে. কর্ণেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. সাখাওয়াত হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ব্লক ইট প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হয়। এর পিএসআই বা চাপ বহনের সক্ষমতা নির্ধারিত। এর মূল্য পোড়ানোর ইটের সমানই বা তুলনামূলক দাম কম।"
তিনি বলেন "এছাড়া, সারাবছরই এর উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ফলে ইটভাটার মতো এক মৌসুমে ইট তৈরি করে তা মজুতের জন্য বেশি ভূমির প্রয়োজন হয় না। ইট ভাটার তুলনায় এক-চতুর্থাংশ ভূমি লাগে।"
বাজার সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, "চাহিদা না থাকলে কারখানা বাড়বে না। বাজার সৃষ্টির দিকে নজর দিতে হবে। অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। এছাড়া, নীতিগত সহায়তাও দিতে হবে।"
এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, "নির্দিষ্ট আয়তনের ইট ভাটায় ভ্যাট নির্ধারিত। কিন্তু পণ্য হিসেবে ব্লক ইটের জন্য ভ্যাট নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ শতাংশ— যেখানে ইট ভাটার ভ্যাট বাবদ ব্যয় ৫ লাখ টাকা। ব্লক ইটের ভ্যাট দেড় কোটি টাকা।"
ব্লক ইটের কারখানার ডিজাইন, ড্রইং, যন্ত্রপাতির সংস্থাসহ পুরো কারখানার স্থাপন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে অ্যাক্সিস এনার্জি লিমিটেড। দেশে ৪২টি কারখানা স্থাপন করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি।
ব্লক ইটের সম্প্রসারণের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে ৫০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে পোড়ানোর ইটের। পরিবেশ বিধ্বংসী ইট ভাটার কারণে প্রায় ৪২ হাজার একর কৃষি জমি হারাচ্ছে দেশ। বিশাল বাজারকে ব্লক ইটের রূপান্তর করতে। কিন্তু এটি সরকারি সিদ্ধান্তেই বাস্তবায়ন হচ্ছে না।"
"স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, গণপূর্ত সামান্য কিছু ব্লক ব্যবহার করছে। এর বাইরে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সরকারি সংস্থাগুলোই প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়ন করছে না। এছাড়া, পরিবহন ব্যয় কমাতে সব জেলায় কারখানা স্থাপন করতে হবে। সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন, পরিবেশ ও জলাবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান টিবিএসকে বলেন, "নতুন ইট ভাটার অনুমতি দেওয়া বন্ধ করেছি। সহসাই প্রজ্ঞাপন জারি হবে। অবৈধ ইট ভাটা ভাঙা এবং সরিয়ে দেওয়া প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া, সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তারা যেন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকল নির্মাণকাজে ব্লক ইট ব্যবহার করে। এই তিনটি কাজ আমরা করছি।"
কৃষি জমি সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার থেকে সরে এসে ধাপে ধাপে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে শতভাগ ব্লক ইট ব্যবহার নিশ্চিত করার পরিকল্পনাটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৯ সালে।
ওই বছর সংসদে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন-২০১৯ পাস হয়।
এরপর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়— ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইনের ক্ষমতা বলে মাটির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমানোর উদ্দেশ্যে সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ভবনে দেওয়াল, সীমানা প্রাচীর, হেরিং বোন বন্ড রাস্তা এবং গ্রাম সড়ক টাইপ 'বি' এর ক্ষেত্রে ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক ব্যবহারের কর্মপরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে সড়ক, মহাসড়কের বেইজ ও সাব-বেইজ নির্মাণ, মেরামত, সংস্কারে এ নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে না বলে জানানো হয় ওই প্রজ্ঞাপনে।
পোড়ামাটির ইটের ভাটা সংকট তৈরি করছে পরিবেশ ও কৃষিখাতে
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সর্বশেষ চলতি বছরের শুরুর হিসাবে দেশে মোট ৮,৬৮৬টি ইট ভাটা রয়েছে। এরমধ্যে ছাড়পত্র নেই ৩,৪৯১টির। এর বাইরে ৯২০টি ইট ভাটা গত তিন বছরে বন্ধ করা হয়েছে। তবে সেগুলো চলছে কিনা, তা নিশ্চিত নয়।
প্রতি ইট ভাটায় বছরে ৩৫ লাখ থেকে শুরু করে ৭০ লাখ ইট উৎপাদন হয়। প্রতিটি ভাটায় গড়ে ৪০ লাখ ইট উৎপাদন ধরা হলে বার্ষিক হিসাব দাঁড়ায় প্রায় ৩,৫০০ কোটির মতো। প্রতিটি ইটের পেছনে গড়ে ৩ কেজি মাটি ব্যবহার হয়। মোট ব্যবহার হচ্ছে ১০ কোটি টন মাটি— যার বেশিরভাগের উৎস কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি (টপসয়েল)।
দেশের নির্মাণ শিল্পে পোড়া ইটের ব্যবহারই বেশি। প্রচলিত পদ্ধতিতে ইট তৈরিতে কৃষি জমির উপরিভাগ ব্যবহারের ফলে কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট হয়। হুমকির মুখে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তাও। এছাড়া, ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয় কয়লা, কাঠ বা গ্যাস। ইটের ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। ভাটায় ব্যবহৃত জ্বালানি কাঠের সংস্থান করতে উজার হচ্ছে বন। পাশাপাশি পরিবেশে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে।
বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) এক সমীক্ষার তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০০ একর কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে— যা মোট চাষযোগ্য জমির এক শতাংশের বেশি। এই ৭০০ একর জমির ১৭ শতাংশ নষ্ট হয় ইট পোড়ানোর ভাটার কারণে। বছরে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় ৪০ মিলিয়ন টন। এর ২২ দশমিক ৫ শতাংশের নিঃসরণ হয় ইট ভাটা থেকে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের পরিবেশ সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, বৃহত্তর ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস ইটভাটা। এ খাত থেকে দূষণের পরিমাণ ১৩ শতাংশ।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী— বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা করা যাবে না। এছাড়া কৃষিজমিতেও ইটভাটা অবৈধ।
অথচ দেশের অধিকাংশ ইটভাটাগুলো আইন মানছে না। কৃষি জমিতে ভাটা স্থাপন, কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার, ব্যবহৃত জ্বালানির সংস্থানে বন উজাড় করে কাঠের ব্যবহার চলছে। আর এসব কাজ সম্পাদন হয়ে আসছে স্থানীয় রাজনীতিক, প্রভাবশালী মহলের সহায়তায়ই।