মিথ্যা ঘোষণায় রেঞ্জ রোভার-বিএমডব্লিউ আমদানি: অটো মিউজিয়ামকে জরিমানা

মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে নতুন আমদানি করা দুটি বিলাসবহুল গাড়ি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করায় ঢাকার গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অটো মিউজিয়ামকে ১৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা জরিমানা করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।
অটো মিউজিয়াম ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি ব্রান্ড নিউ রেঞ্জ রোভার ও একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি আমদানি করে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়ি দুটি খালাসের সময় কাস্টমসে দাখিল করা বিল অব এন্ট্রিতে আমদানিকারকের প্রতিনিধি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিথ্যা তথ্য দেয় বলে দাবি কাস্টমসের।
আমদানি করা রেঞ্জ রোভার ও বিএমডব্লিউ এক্স৭– দুটি গাড়িরই ইঞ্জিন ক্ষমতা প্রায় ৩,০০০ সিসি।
কিন্তু বিল অফ এন্টিতে অটো মিউজিয়ামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আহমেদ এন্টারপ্রাইজ গাড়ি দুটিকে 'মাইল্ড হাইব্রিড' গাড়ি হিসেবে ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে, নন-হাইব্রিড প্রমাণ হওয়ার পর বন্দর থেকে গাড়ি দুটির খালাস আটকে দেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
এই মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানিকারক মোট ৬,২০,৬৪,৮৯৩ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বলে জানায় কাস্টমস অফিস। কারণ হাইব্রিড গাড়ির আমদানি শুল্ক নন-হাইব্রিড গাড়ির আমদানি শুল্কের প্রায় অর্ধেক। যেমন— ২৯৯৬ সিসির হাইব্রিড গাড়ির শুল্ক ২২১ শতাংশ। একই সিসির নন হাইব্রিড গাড়ির শুল্ক ৪৩০ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্ট সেল-সিআইসি, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্স (এআইআর) ইউনিটের তদন্তে মিথ্যা ঘোষণার বিষয়টি প্রমাণিত হলে, অটো মিউজিয়ামকে ১৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা জরিমানা করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।
গত ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফাইজুর রহমান দুটি পৃথক বিচারাদেশে এই জরিমানা করেন।
এর মধ্যে রেঞ্জ রোভার গাড়িতে মিথ্যা ঘোষণার জন্য ৭.৭২ কোটি টাকা এবং বিএমডব্লিও গাড়িতে ৫.৪৫ কোটি জরিমানা করে করে কাস্টমস।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার ফাইজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমদানিকারক অটো মিউজিয়ামের আমদানি করা দুটি গাড়ি নন-হাইব্রিড ক্যাটাগরির। হাইব্রিড সুবিধায় খালাস দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মিথ্যা ঘোষণা দেওয়ার অপরাধে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে।"
এদিকে, গাড়ি আমদানিকারক অটো মিউজিয়ামের মালিক মো. হাবিব উল্লাহ ডন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভিকেলস ইম্পোর্টারস অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি।
যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে মো. হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, শুল্ক কর্মকর্তারা গাড়ি আমদানিকারকদের হয়রানি করছেন, কারণ এর আগেও আমদানি করা অনেক মাইল্ড হাইব্রিড গাড়িকে হাইব্রিড গাড়ি হিসেবে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, "গত চার বছরে, মাইল্ড হাইব্রিড ঘোষণার আওতায় অন্তত ৪০০টি গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কাস্টমসের এমন আকস্মিক সিদ্ধান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অনৈতিক।"
"আমার আমদানি করা গাড়িগুলো হাইব্রিড। হাইব্রিড আমদানির বিষয়ে এনবিআর এখনো কোনো এসআরও করেনি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুধু শুধু আমাদের হয়রানির জন্য গাড়ির খালাস আটকে দিয়েছে। আমি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব," যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস জানায়, ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউসও) ক্লাসিফিকেশন অনুযায়ী, মাইল্ড হাইব্রিড গাড়িকে হাইব্রিড গাড়ি হিসেবে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই গাড়িগুলোও নন-হাইব্রিড গাড়ি হিসেবে শুল্কায়ন হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, মিথ্যা ঘোষণায় গাড়ি আমদানি করায় আমদানিকারকের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কাস্টমস। আমদানিকারক লিখিত জবাবে সব ধরনের হাইব্রিড গাড়ির একই শুল্ক হারের কথা উল্লেখ করেছেন, যা সঠিক নয়। কারণ, শুল্ক হার নির্ভর করে মূলত গাড়ির সিসি ও গাড়িতে ইলেক্ট্রিক মোটরের কার্যক্রমের উপর। আমদানিকৃত গাড়িতে ইলেক্ট্রিক মোটর প্রোপালশনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে না– সেহেতু গাড়িটি এক্সপ্লেনেটরি নোটসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সন্দেহাতীতভাবে নন-হাইব্রিড হিসেবে চিহ্নিত।
কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটেন থেকে ২০২৩ সালে প্রস্তুতকৃত একটি রেঞ্চ রোভার গাড়ি আমদানি করে অটো মিউজিয়াম। ইনভয়েসে গাড়ির দাম উল্লেখ করা হয় জিবিপি ১ লাখ ৫ হাজর ব্রিটিশ পাউন্ড। গাড়িটি খালাস নিতে ২০২৪ সালের ৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আহমেদ এন্টারপ্রাউজ।
আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী, গাড়িটি ব্র্যান্ড নিউ রেঞ্জ রোভার ১৪০০ অটোবায়োগ্রাফি হাইব্রিড জিপ, সিসি–২৯৯৬। পণ্য চালানটি কাস্টমস এবং সিআইসি কর্মকর্তারা কায়িক পরীক্ষা করে। কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আমদানিকৃত ব্র্যান্ড নিউ রেঞ্জ রোভার ১৪০০ অটোবায়োগ্রাফি হাইব্রিড ইলেক্ট্রিক ভিকেল (এইচই:ভিএস) হিসেবে শ্রেণিবিন্যাস করার সুযোগ নেই। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, আমদানিকারক গাড়ি খালাসে মিথ্য ঘোষণা দিয়েছে।
আমদানিকৃত গাড়িটি পেট্রোল ইঞ্জিন গাড়ি হিসেবে শ্রেণিবিন্যাসযোগ্য। গ্রাসেস গাইড অনুযায়ী, এই গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১,৫৭,৮১,৯৯৫ টাকা। মিথ্য ঘোষণার মাধ্যমে এই গাড়ির চালনটিতে ৩,৬৩,৬১,৭১৬ টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে আমদানিকারক।
পণ্য চালানটি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে ৭ কোটি ৩২ লাখ অর্থদণ্ড এবং ৪০ লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা আরোপ করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান।
একই আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রান্ড নিউ বিএমডব্লিউ এক্স৭ এক্সড্রাইভ ৪০১হাইব্রিড জিপ সিসি ২৯৯৮ গাড়ি আমদানি করেন। গাড়িটি খালাসের জন্য আমদানিকারকের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। একইভাবে সিআইসি, কাস্টম কায়িক পরীক্ষা করে গাড়িটি নন-হাইব্রিড হিসেবে চিহ্নিত হয়। কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদনে বিএমডব্লিও গাড়িটিও নন হাইব্রিড গাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করে কাস্টমস।
গ্লাস গাইড অনুযায়ী, গাড়িটির শুল্কায়ন মূল্য ১,১১,৫৫,৮৯২ টাকা। মিথ্যা ঘোষণার কারণে গাড়িটিতে ২,৫৭,০৩,১৭৭ টাকা শূল্ক ফাঁকির চেষ্টা করা হয়। শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করায় আমাদনিকারককে ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং ৩০ লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা করা হয়।