‘কমলা’ থেকে ‘লাল’: জাহাজভাঙ্গা শিল্পের শ্রেণি জটিলতায় বড় লোকসানের মুখে খাত সংশ্লিষ্টরা

কাঁচামাল সংকটে ইস্পাত শিল্পের (শিপব্রেকিং, রি-রোলিং মিল ও অক্সিজেন) বেশিরভাগ কারখানায় কার্যক্রম যখন বন্ধ, ঠিক তখনই উদ্যোক্তাদের মনে আশা জাগিয়েছে সীমিত পরিসরে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি।
কিন্তু জাহাজভাঙ্গা শিল্পের শ্রেণি জটিলতা নিয়ে আবারো বড় অংকের লোকসানের মুখে পড়েছে এসব খাতের উদ্যোক্তারা।
কারণ গত তিন-চার মাসে কিছু ব্যাংক সীমিত আকারে পুরানো জাহাজ আমদানির সুযোগ দিলেও পরিবেশের অনুমোদন না পাওয়ায় তা কাটতে পারছেন না উদ্যোক্তারা।
এতে গত তিন মাস ধরে ইয়ার্ডে পড়ে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকায় আমদানি হওয়া ৬৬ স্ক্র্যাপ জাহাজ; যেসব জাহাজের কাটিং হলে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন কাঁচামাল যোগ হবে রি-রোলিং মিলগুলোতে।
শিপব্রেকিং খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আগে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ৪৮ ঘণ্টায় আমদানি হওয়া পুরানো জাহাজ ভাঙ্গার অনুমতি মিললেও গত মার্চ থেকে তারা কোন অনুমতি পাচ্ছেন না।
হঠাৎ করে মার্চে এই শিল্পকে কমলা-বি (কম বিপজ্জনক) থেকে লাল (অধিক বিপজ্জনক) শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করায় এই জটিলতার সৃষ্টি হয়। ফলে আমদানি করা জাহাজ কাটতে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নেওয়ার পর ঢাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে অনুমতি নিতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে অনুমতি দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকায় পাঠানোর পর অনুমতির অপেক্ষায় পড়ে আছে এইসব আবেদন।
ফলে ডলার সংকট কাটিয়ে উঠে কিছু কিছু ব্যাংক স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির এলসি খুললেও দেশে এসে ইয়ার্ডে পড়ে আছে এসব জাহাজ। এতে প্রভাব পড়েছে শিপ ব্রেকিংয়ের সাথে জড়িত ইস্পাত ও অক্সিজেন খাতেও।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স (বিএসবিএ) এর তথ্যমতে, তিন মাস ধরে জাহাজ না থাকায় ৩৩ ইয়ার্ডের কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক বেকার বসে আছে।
বিএসবিএ'র সভাপতি ও তাহের গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু তাহের বলেন, ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় এমনিতেই গত একবছর ধরে শিপ ব্রেকিং খাতে স্থবিরতা চলছে। এরমধ্যে জাহাজ আমদানির পর অনুমোদনের অপেক্ষায় দীর্ঘদিন আটকে থাকায় ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এরমধ্যে একদিকে বসিয়ে বসিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে ১০ হাজার কোটি টাকার আমদানি মূল্যের বিপরীতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬৬ কোটি টাকার সুদ গুনতে হচ্ছে এসব জাহাজ আমদানিকারদের।
তিনি আরো বলেন, কাজ না থাকায় ইয়ার্ড ছেড়ে চলে গেছে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকরা। এতে পরে জাহাজগুলো কাটার অনুমোদন পেলেও সেই সময় শ্রমিক মেলা কঠিন হয়ে যাবে।
জাহাজভাঙ্গা খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ডলার সংকট কিছুটা কমে আসায় কিছু কিছু ব্যাংক এখন স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে এলসি দিচ্ছে। এতে গত তিন-চার মাসে আমদানি কিছুটা বাড়লেও অনুমোদন জটিলতায় আবারো সংকটে পড়েছে খাতটি। বিশেষ করে ৫ মার্চ প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ এ শিপব্রেকিং শিল্পকে 'লাল' শ্রেণিভুক্ত করার পর থেকে এই খাতে স্থবিরতা শুরু হয়েছে।
আমদানি প্রক্রিয়া শেষে জাহাজটি বহির্নোঙ্গরে আসার পর কাটার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়, নৌ-বাণিজ্য দপ্তর, কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ নেভি, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও কলকারখানা অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়। এসব সংস্থার প্রতিনিধিরা বহির্নোঙ্গরে ভিজিটের অনুমতি পেলে জাহাজটি ইয়ার্ডে বিচিং করা হয়।
আগে এসব সংস্থার অনুমোদন শেষে আমদানিকৃত জাহাজ কাটার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগতো। যা সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অনুমোদন পাওয়া যেতো। কিন্তু শিল্পটিকে লাল শ্রেণিভুক্ত করার পর দ্বিতীয় দফায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হচ্ছে, যাতে দুই-তিন মাসের বেশি সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। এতে কাঁচামাল সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইয়ার্ড মালিকরা।
বিশেষ করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সভা হয় ২১ দিন পরপর। কোনো কারণে এক সভায় অনুমোদন না হলে তাতে দেড় মাস পার হয়ে যায়।
এছাড়া আগে লাল শ্রেণি থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের দুইবার অনুমোদন নিতে হতো না। এখন একবার পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে আবার পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগছে।
আমদানিকারকরা জানান, আমদানিকৃত এসব জাহাজ যত দ্রুত কেটে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করা যায় তত ভালো। কারণ ২০০-২৫০ কোটি টাকায় আমদানি করা এসব জাহাজ বসিয়ে রাখলে দিনে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা ব্যাংক ইন্টারেস্ট গুনতে হচ্ছে। সেই হিসেবে, আটকে থাকা ৬৬ জাহাজে প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যাংক ইন্টারেস্ট গুনতে হচ্ছে।
কেআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন টিংকু বলেন, "ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে গত এক-দেড় বছর এই খাতের উদ্যেক্তাদের বড় লোকসান গুনতে হয়েছে। কারণ এক বছর আগে যখন জাহাজ কিনি তখন ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫-৯০ টাকার মধ্যে। ডেফার্ড এলসির মাধ্যমে আমদানি হওয়া পুরোনো জাহাজের এখন সেই আমদানিমূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ১১০ টাকার উপরে।"

পরিবেশের বক্তব্য
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, "একসময় জাহাজভাঙ্গা শিল্প কমলা (খ) শ্রেণিভুক্ত ছিলো। তখন চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে জাহাজ কাটার সুযোগ ছিল। কিন্তু মার্চে এই শিল্পকে লাল শ্রেণিভুক্ত করায় এখন চট্টগ্রাম থেকে অনুমোদন নেয়ার পর প্রধান কার্যালয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হয়। গত এক-দেড় মাসে ৩৮ জাহাজ কাটার জন্য আবেদন করেন উদ্যোক্তারা। আমরা ইতোমধ্যে ৩০টি অনুমোদন দিয়ে তা ঢাকায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছি।"
"অনুমোদন নিয়ে সময়ক্ষেপণ ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছে। প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা পেলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিব।"
তবে পরিবেশ অধিপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদকে ফোনে চেষ্টা করে পাওয়া যায় নি।
এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার টিবিএসকে বলেন, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড পরিবেশের দূষণ ঘটায় তাই এটিকে পুনরায় 'লাল' শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।
"পরিবেশ অধিদপ্তর আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করবে এবং ছাড়পত্র দেওয়ার আগে জাহাজগুলো পরিদর্শন করবে", যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রামের জাহাজভাঙ্গা শিল্পকে ১৯৯৭ সালে প্রথম কমলা (খ) শ্রেণির আওতায় ফেলা হয়। ২০০৭ সালে একে 'লাল' শ্রেণিতে আনা হয় এবং ২০২০ সালে আবারও 'কমলা (খ)' হিসাবে পুনঃশ্রেণিবদ্ধ করা হয়।
শিপব্রেকিংয়ের প্রভাব ইস্পাত খাতে
এদিকে জাহাজভাঙ্গা শিল্পের এই সংকটের প্রভাব পড়েছে ইস্পাত শিল্পেও। প্রতি টন রডের দাম পৌঁছেছে লাখ টাকায়। এরমধ্যে গত দুই-তিন মাস ধরে ইয়ার্ডগুলোতে জাহাজভাঙ্গা বন্ধ থাকায় রি-রোলিং মিলগুলোতে স্ক্র্যাপ বা কাঁচামালের সংকট রয়েছে; এতে প্রতি টন লাখ টাকায় পৌঁছানো রডের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং কবির শিপ রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটিজ নামক একটি গ্রিন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী মেহেরুল করিম বলেন, "কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জাহাজভাঙার অনুমোদন পেতে যে বিলম্ব হচ্ছে তা ইস্পাত প্রস্তুতকারকদের কাঁচামালের সাপ্লাই চেইনকে ব্যাহত করছে।"
"আমরা স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে বিলেট এবং তারপর বিভিন্ন গ্রেডের স্টিল তৈরি করি। স্ক্র্যাপ জাহাজের স্বল্পতায় ইস্পাত প্রস্তুতকারীরা কাঁচামালের ঘাটতি অনুভব করছে।"
চিটাগাং স্টিল রি-রোলিং মিলস ওনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এম মনজুর আলম বলেন, চট্টগ্রামে অটো (৭৫ গ্রেড), সেমি অটো (৬০ গ্রেড) ও ম্যানুয়ালসহ (৪০ গ্রেড) প্রায় ৫০টি ইস্পাত কারখানা ছিল। উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয়মূল্য সমন্বয় করতে না পারায় গত তিন বছরে ৪৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়েকটি কারখানা কোনোভাবে চালু আছে- কাঁচামাল (স্ক্র্যাপ) ও জ্বালানির সংকট এবং দাম বৃদ্ধিতে সেসব কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে।
শ্রমিকদের মানববন্ধন
দীর্ঘদিন ইয়ার্ডে কাজ না থাকায় মানববন্ধন করেছে জাহাজভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিকরা। গত শনিবার সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি এলাকায় বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সামনে তারা এই মানববন্ধন করে।
এসময় শ্রমিকরা দাবি করেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে অনেকগুলো জাহাজ কাটিং কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না মালিকরা। এতে শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন। তারা এ সংকটের আশু সমাধানের দাবি জানান।