পূরণ হতে চলেছে মেট্রোরেল স্বপ্ন, উদ্বোধনের আগে শেষ মুহূর্তের জোর প্রস্তুতি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেট্রোরেল উদ্বোধনের খবর সামনে আসার পরই জোর কদমে চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। বাংলাদেশের অর্জনের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত করতে চলেছে মেট্রোরেল।
সরেজমিন পরিদর্শনে মেট্রো স্টেশনগুলোতে যায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একটি দল। সেখানেই দেখা যায় উদ্বোধনের প্রস্ততি চলছে জোরেশোরে। কোথাও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে, আবার কোথাও চলছে শেষ মূহুর্তের শোভা বর্ধন ও রক্ষণের কাজ।
রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাওঁ পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার মেট্রো রেললাইনে ৯টি স্টেশনের মধ্যে পাঁচটির সব ধরনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে কয়েক মাস আগেই।
উত্তরার স্টেশনগুলোতে মেট্রো রেলের স্থায়ী কর্মী ছাড়া আর কোনো লোকজনের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। কম্পিউটারে কিছু নেটওয়ার্ক ক্যাবল লাগানো আর কিছু সফটওয়্যার আপডেট দেয়া ছাড়া এ সব স্টেশনে কোন কাজ বাকি নেই বলে জানান একাধিক স্টেশন অপারেটর।
তবে দক্ষিণ প্রান্তের ষ্টেশনগুলো বিশেষ করে শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়া এলাকার স্টেশনগুলোতে এখনও কাজ চলছে পুরোদমে। এই দুই স্টেশনে কয়েকশ নির্মাণ শ্রমিক এক্সিট ও এন্ট্রি পথের নির্মাণে কাজ করছেন। শেওড়া পাড়া স্টেশনে এসকালেটর নির্মাণের কাজ এখনও শুরুই হয়নি।
তবে দেশের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধন নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা গেছে সবখানেই।
চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের যেকোনো দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রো রেলের বাণিজ্যিক যাত্রা উদ্বোধন করবেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ম্যানেজিং ডিরেক্টর এমএএন সিদ্দিক।

তবে দুটি স্টেশনের এন্ট্রি ও এক্সিট পথ নির্মাণ, মেট্রো রেলের নিরাপত্তায় বিশেষায়িত এমআরটি পুলিশের চূড়ান্ত অনুমোদনসহ বেশ কিছু জটিলতার কারণে উদ্বোধনের পরপরই পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু সম্ভব হবে না।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্ট্রিগ্রেটেড টেস্ট শেষে মেট্রো ট্রেনের সার্ভিস অপারেশন শুরু হয়েছে চলতি মাসের প্রথম দিকে। এই অপারেশন শেষে ব্ল্যাঙ্ক অপারেশন (যাত্রী ছাড়া চলাচল) শুরু হবে মাসের শেষের দিকে।
এম এ এন সিদ্দিক টিবিএসকে বলেন, চলতি মাসের শুরুতে উত্তরা আগারগাঁও অংশের কাজে অগ্রগতি হয়েছে ৯৫ শতাংশ। এই অংশের স্টেশনগুলোর নির্মাণ অগ্রগতি ৯৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। তবে শেওড়াপাড়া স্টেশনের কাজ এখনও চলছে।
যা দেখা গেল সরেজমিনে
শেওড়াপাড়া মেট্রো রেল স্টেশনের চারটি এন্ট্রি-এক্সিট পথের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে দুইটির। অপর দুটি পথের কাজ করছেন শতাধিক শ্রমিক। জানতে চাইলে কয়েকজন শ্রমিক বলেন, এই কাজ শেষ হতে আরও অন্তত ১৫ দিন লাগবে। এরই মধ্যে একটি এসকেলেটর স্থাপনের কাজও শুরু হয়েছে।
চলতি মাসের মধ্যে এই স্টেশনের কাজ শেষ করা যাবে না বলে তারা দাবি করেছেন।
কাজীপাড়া স্টেশনের কর্মীরা কাজ শেষ করতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন।

এক সপ্তাহ আগেও আগারগাঁও স্টেশনে এন্ট্রি-এক্সিট পথ, এসকালেটর স্থাপন ও ফুটপাথ উন্নয়নের কাজ চলছিল। কাজ শেষে এখন আর এই স্টেশনে কোনো নির্মাণ শ্রমিক নেই।
প্রতিটি স্টেশনেই স্টেশন অপারেটরদের সঙ্গে পুরো স্টেশন ঘুরে দেখেছে টিবিএস টিম। স্টেশন অপারেটররা জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব পর্যন্ত ট্রেন পরিচালনার পর ট্রেন অপারেটররা কম্পিটেন্সি সার্টিফিকেট পেয়ে থাকেন। চলমান সার্ভিস অপারেশনের মাধ্যমে চালকদের কমপিটেন্সি বাড়ানো হচ্ছে। উদ্বোধনের আগে যথেষ্ট সংখ্যক অপারেটর এই সার্টিফিকেট না পেলে সেবা পরিচালনা কঠিন হবে বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।
অবশ্য উদ্বোধনের পরপরই পুরোদমে মেট্রো রেল সেবা দেয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন এমএএন সিদ্দিক। তিনি বলেছেন, সীমিত সংখ্যক যাত্রী নিয়ে সকালে ও বিকালে কয়েকটি ট্রেন পরিচালনার মাধ্যমে মেট্রো রেল সেবা দেওয়া হবে। উদ্বোধনের তিন মাস পরে পুরোদমে সেবা চালু করা হবে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্বৃতি দিয়ে ঘোষণা দেওয়ায় ডিসেম্বরে মেট্রো রেল চালুর বিকল্প থাকছে না। তবে সব ধরনের প্রস্তুতি না নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে এই সেবা চালু করা ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের লোকজন যে কোনো বিষয়ে অতিউৎসাহী হওয়ায় মেট্রো রেল চালুর আগেই এমআরটি পুলিশ গঠনের কাজ শেষ করা উচিত ছিল। আবার পুলিশের এই ইউনিটে নিয়োজিতদের প্রশিক্ষণের জন্যও সময় প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, উদ্বোধনের আগে স্টেশনসহ প্রকল্পের সব ধরনের সিভিল কাজ যেকোনো মূল্যে শেষ করা উচিত। এ লক্ষ্যে চলমান উদ্যোগগুলো আরও জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি।
দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি উদ্বোধনের
সোমবার রাজধানীর এমআরটির দিয়াবাড়ি ডিপোতে মেট্রোরেল প্রদর্শনী ও তথ্য কেন্দ্রে এক ব্রিফিংয়ে এম এ এন সিদ্দিক জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের যেকোনো দিন উত্তরা থেকে আগারগাঁও রুটে মেট্রোরেল সার্ভিসের উদ্বোধন করবেন।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় উদ্বোধনের তারিখ এখনো চূড়ান্ত করেনি।

এমআরটি-৬ প্রকল্পের প্রধান অর্থায়নকারী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে।
জাইকার বাংলাদেশ অফিসের প্রধান প্রতিনিধি ইউহো হায়াকাওয়া বলেন, এমআরটি দক্ষ, আরামদায়ক, নিরাপদ ও সময়-সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা প্রদানের মাধ্যমে ঢাকার সাধারণ মানুষের জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।
তিনি বলেন, এমআরটি গণপরিবহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ মাধ্যম। তিনি আশা করেন এই প্রকল্পটি কর্মক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে বিশেষ করে নারীদের জন্য যথেষ্ট সাহায্য করবে।
এমএএন সিদ্দিক বলেন, 'আমরা সিস্টেম ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট শেষ করেছি এবং ৪ ডিসেম্বর সার্ভিস ট্রায়াল শুরু করেছি। ব্ল্যাঙ্ক অপারেশন ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে শুরু হবে,' তিনি বলেন।
তিনি বলেন, সীমিত সংখ্যক যাত্রী নিয়ে সকালে ও বিকালে কয়েকটি ট্রেন পরিচালনার মাধ্যমে মেট্রো রেল সেবা দেওয়া হবে। যাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকলে ট্রেনের সংখ্যা এবং পরিষেবার সময় ধীরে ধীরে বাড়বে।
শুরুর দিকে স্টেশনগুলোতে ট্রেন দীর্ঘ সময়ের জন্য থামবে। তবে সময়ের সঙ্গে থামার সময়কাল কমিয়ে আনা হবে। কম স্টপেজ টাইম শুরুতে যাত্রীদের জন্য অস্বস্তি তৈরি করবে।
২০১২ সালে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রো রেল স্থাপনে ২২ হাজার কোটি টাকার এমআরটি লাইন ৬ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক।
মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আরও ১.১৬ কিলোমিটার সম্প্রসারণসহ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায়।
মেট্রোরেল লাইন দিনে প্রায় পাঁচ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম হবে। প্রতি ঘণ্টায় যেকোনো দিক থেকে ১৬ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে
ঘণ্টায় ১০০ কি.মি. পর্যন্ত গতিতে চলবে মেট্রোরেল ফলে উত্তরা থেকে মতিঝিল ভ্রমণের সময় বর্তমানে আড়াই ঘন্টা থেকে কমে আসবে ৪০ মিনিটে। একটি ট্রেন উত্তরা থেকে আগারগাঁও আসতে ১৭ মিনিট সময় নেবে।