সার্জিক্যাল মাস্ক কোভিডের বিস্তার কমায়, বাংলাদেশে ইয়েলের গবেষণা

সার্জিক্যাল মাস্কের ব্যাপক ব্যবহার একটি সম্প্রদায়ে করোনাভাইরাসের বিস্তারকে সীমিত রাখতে পারে। বাংলাদেশে পরিচালিত একটি বিস্তৃত গবেষণা প্রকল্পের সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের ৬০০টি গ্রামের ৩ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি লোক জড়িত ছিল এই পরীক্ষামূলক (ট্রায়াল) সমীক্ষায়। গত বছরের নভেম্বরে শুরু হওয়া এ ট্রায়াল শেষ হয় এ বছরের এপ্রিলে। এ প্রকল্পে মসজিদ, বাজার এবং অন্যান্য গণজমায়েত স্থানে সাধারণ লোকদেরকে সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মাস্ক ব্যবহার এবং শারীরিক দূরত্বের মাত্রা মূল্যায়ন করা হয়েছে।
ইয়েল, স্ট্যানফোর্ড এবং বাংলাদেশী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রিনভয়েসের কয়েক জন সহ গবেষকদের একটি দল বাংলাদেশে এ সমীক্ষা চালায়। এ গবেষণার প্রধান পরিচালনাকারীরা হলেন অ্যাবালাক, লরা ক্যোং, স্টিভ লুবি, আহমেদ মুশফিক মোবারক এবং অ্যাশলে স্টাইজিনস্কি।
কেবল মাস্কের কার্যকারিতাই নয়, বরং একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারকে উৎসাহিত করার জন্য নেওয়া জনস্বাস্থ্য পদ্ধতিও বিবেচনা করা হয়েছে গবেষণাটির মাধ্যমে।
এ কাজে অংশগ্রহণকারীদের প্রথমত দু'ভাগে ভাগ করা হয়। এদের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার গ্রামবাসী ছিলেন ইন্টারভেনশন গ্রুপে, এবং এক লাখ ৬৩ হাজার গ্রামবাসী ছিলেন কন্ট্রোল গ্রুপে। গবেষকেরা লক্ষ্য করেন, ইন্টারভেনশন গ্রুপের লোকদের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারের হার ১৩ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশে যেয়ে পৌঁছায়। এছাড়া, মাস্ক ব্যবহারের এ হার একাধারে ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, এবং ইন্টারভেনশন শেষ হওয়ার পরেও অব্যাহত ছিল।
গবেষণার প্রথম ধাপে গবেষকরা লক্ষ্য করেন, মাস্ক ব্যবহার বাড়াতে মূলত চারটি বিষয় দায়ী। বিষয়গুলো হলোঃ বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণ, মাস্কের ব্যবহার বিষয়ে তথ্য প্রদান, ব্যক্তিগতভাবে এবং জনসমক্ষে মাস্ক ব্যবহারে জোর দেওয়া, এবং বিশ্বস্ত নেতাদের অনুমোদন ও মডেলিং।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় ধাপে গবেষকরা কোভিডের উপসর্গের হার পরীক্ষার জন্য দুটি দলে ভাগ করা গ্রামগুলো পরীক্ষা করেন। তারা জানান, যেসব গ্রামে মাস্ক ব্যবহারের প্রচার কর্মসূচি চালানো হয়েছিলো (ইন্টারভেনশন গ্রুপ), সেখানে অন্যান্য গ্রামের তুলনায় সংক্রমণের হার ছিলো ৯.৩ শতাংশ কম। এছাড়া, কাপড়ের মাস্কের বদলে সার্জিক্যাল মাস্ক বিতরণ করা হলে, সার্বিকভাবে সংক্রমণ কমতে দেখা যায় ১১ শতাংশ। সেই সাথে সংক্রমণ কমার এ হার ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে কমে ২৩ শতাংশ, এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে কমে ৩৫ শতাংশ।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ইমার্জেন্সি মেডিসিন ফিজিশিয়ান মেগান এল. র্যানি বলেন, এই গবেষণার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে। প্রথমত, এটি প্রমাণ করে যে, মাস্ক ব্যবহার একজন মানুষকে এবং তার সম্প্রদায়ের অন্যান্যদেরকে রক্ষার কাজ করে। দ্বিতীয়ত, গবেষণাটি নির্দেশ করে যে উন্নত মানের মাস্কগুলো উচ্চতর সুরক্ষা প্রদান করে থাকে। তৃতীয়ত, কিভাবে একটি সম্প্রদায়ের মানুষকে মাস্ক ব্যবহারে অনুপ্রাণিত করা যায়, এবং এটিকে একটি সামাজিক রীতি হিসেবে গড়ে তোলা যায় তা বোঝা যায় এ সমীক্ষার মাধ্যমে।
ইয়েলের অর্থনীতিবিদ জেসন অ্যাবালাক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "এ গবেষণার প্রেক্ষিতে জনবহুল স্থানে কোভিড মোকাবেলায় মাস্ক কার্যকর হতে পারে কিনা সে বিষয়ে যেকোনো ধরণের বৈজ্ঞানিক বিতর্কের অবসান ঘটা উচিত বলে আমি মনে করি।"
তবে গবেষণাটি কাপড়ের মাস্ক এবং সার্জিক্যাল মাস্কের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো বক্তব্য দেয় না। অ্যাবালাক বলেন, "সার্জিক্যাল মাস্ক যে কাপড়ের মাস্কের চেয়ে অনেক ভালো, এমনটি দেখা যায় না গবেষণার ফলাফলে। তবে আমরা সার্জিক্যাল মাস্কের কার্যকারিতার বেশ কিছু স্পষ্ট প্রমাণ পাই"।
এছাড়া তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, ইন্টারভেনশন গ্রুপের লোকদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব পালনের বিষয়টিও দেখা গিয়েছে। এর ফলে, মাস্কের কার্যকারিতার বিষয়ে প্রাপ্ত ফলাফল হয়ে উঠতে পারে আরো জটিল। তবে, মাস্ক ব্যবহার বাড়লেও মসজিদের মতো স্থানে যাতায়াতকারীদের মধ্যে কোনো ধরণের "শারীরিক দূরত্ব" ছিল না বলে যোগ করেন তিনি।
তবে গবেষণার লেখকরা এ বিষয়ে আরো গবেষণা চালানোর পরিকল্পনা করেছেন।
বর্তমানে এ গবেষণাপত্রটি জার্নাল সায়েন্সের পর্যালোচনার অধীনে রয়েছে। কিন্তু, বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য পর্যায়ে এসকল তথ্যের সম্ভাব্য গুরুত্বের কারণে গবেষকেরা তাদের এ সমীক্ষার ফলাফল দেখার অনুমতি দিয়েছেন সাংবাদিকদেরকে। এছাড়াও, যেসকল বিশেষজ্ঞকে এ গবেষণাটি পর্যালোচনার জন্য দেখানো হয়েছিল, তারাও এর প্রশংসা করেন। এমনকি, এ গবেষণা মাস্ক ব্যবহারের বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যুক্তি হতে পারে বলেও উল্লেখ করেছেন অনেকে।
র্যানি বলেন, "এটি অবিশ্বাস্যভাবে চ্যালেঞ্জিং কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা। মাস্ক-বিরোধী লোকেরা এতদিন র্যান্ডমাইজড নিয়ন্ত্রণাধীন ট্রায়াল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, এবং এ গবেষণায় সেটিই করা হয়েছে"।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ও'নিল ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্লোবাল হেলথ ল- অনুষদের পরিচালক লরেন্স গোস্টিন বলেন, "এটা শুধু একটি সমীক্ষার মডেল নয় বা পূর্ববর্তী গবেষণার পর্যালোচনা নয়। বরং এটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের একটি আদর্শ মান।"
অ্যাবালাক বলেন, "এটি এমন একটি প্রকল্প যা মুষ্টিমেয় লোক দ্বারা করা সম্ভব না। এ কারণেই প্রকল্পটির সাথে শত শত মানুষ জড়িত। আমি জানি না এখানে ঠিক কতজন যুগ্ম-লেখক রয়েছেন"।
লেখকদের মতে, তাদের এ গবেষণাটি ভবিষ্যতের অন্যান্য গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে। এছাড়াও, অন্যান্য রোগ প্রতিরোধের জন্য মাস্ক ব্যবহারের বিষয় বিশ্লেষণেও এ গবেষণা ভূমিকা রাখবে।
গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, "শ্বাসযন্ত্রের লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিরা সার্স-কোভ-২ ভাইরাস সহ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করতে মাস্ক পরবেন কিনা- এটি ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এই গবেষণার ফলাফলগুলো থেকে বোঝা যায় যে এই ধরনের নীতি জনস্বাস্থ্যের উপকার সাধন করতে পারে"।
গবেষকদের দলটি বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিল এ সমীক্ষার যুগ্ম-লেখক এবং ইয়েল অর্থনীতিবিদ মুশফিক মোবারকের কারণে। মোবারক একজন বাংলাদেশী এবং তিনি এর আগেও সেখানে কাজ করেছেন। এছাড়া ফান্ডিংয়ের জন্য বর্ধিত বিকল্পের কারণেও বাংলাদেশকে বেছে নেয় তারা।
- সূত্র- দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট