যুবককে পিটিয়ে হত্যা ও আগুনে পোড়ানোর ঘটনায় তদন্ত শুরু

কোরআন শরীফ অবমানার গুজব ছড়িয়ে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর মহাসড়কে এনে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক। বৃহস্পতিবার বিকালে জেলার বুড়িমারীতে ওই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
নিহত যুবক শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর নগরীর শালবন মিস্ত্রীপাড়া এলাকার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন জুয়েল।
শুক্রবার সকালে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর।
এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুয়েল নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরীফ নামাতে গেলে অসাবধনাতাবশত কয়েকটি কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ের ওপর পড়ে যায়।
সেগুলো তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। তবে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান যোবাইয়েরকে পাশে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখে। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত হন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। এ সময় উত্তেজিত জনতা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দরজা জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।
পরে মরদেহ টেনে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে এনে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ ও বিক্ষোভ মিছিল করে।
সেদিন সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ প্রায় ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ১৭ রাউন্ড ফাঁকাগুলি ছোড়ে।
বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর ও পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান যোবাইয়েরকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে লালমনিহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছে পুলিশ। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি র্যাবের সদস্যরা টহল অব্যাহত রেখেছেন।
এদিকে ঘটনাটি তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টি এম এ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে, রংপুর র্যাবের অধিনায়ক রেজা ফেরদৌস আহমেদ জানান, র্যাবের পক্ষ থেকে ঘটনাটির ছায়া তদন্ত করা হচ্ছে।
পাটগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ সুমন্ত কুমার মোহন্ত বলেন, এ ঘটনায় নিহতের পরিবার, পুলিশের ওপর হামলা ও ইউনিয়ন পরিষদ ভাঙচুরের দায়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে পুলিশ।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, এ ঘটনায় তদন্ত করে মামলা করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্তে ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, রিপোর্ট পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, ঘটনাস্থলে পুলিশ ও র্যাব টহল দিচ্ছে। পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশের কয়েকটি ইউনিট। তবে ওই এলাকায় মাইকিংসহ বিভিন্নভাবে সর্তকতামূলক কাজ করার জন্য জনসাধারণকে বলা হচ্ছে।