মহামারিতে বাড়ছে সাইবার অপরাধ

জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরীর নামে ফেসবুক আইডি খুলেন টাঙ্গাইলের জাহিদ বিন আজিজ নামে এক ব্যক্তি। করোনায় চাকুরি হারিয়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন সাইবার অপরাধে।
এই আইডি থেকে চিফ হুইপের ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করে যোগাযোগ স্থাপন করেন জাহিদ।
প্রায় প্রতিদিন চিফ হুইপের নানা সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানের ছবি ওই আইডি থেকে পোস্ট করতেন তিনি, যেন কেউ সন্দেহ না করে ভুয়া আইডি বলে।
'হাই, হ্যালো' দিয়ে কথোপকন শুরু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সখ্যতা গড়ে তারপর শুরু করেন প্রতারণা। চাকরি ও বড় বড় কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে এবং তদবির বাণিজ্য করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন জাহিদ।
নভেম্বরে মাসে সাইবার ক্রাইম ডিভিশনের ডিজিটাল ফরেনসিক টিম রাজধানী থেকে জাহিদকে গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইল ফোনে চিফ হুইপের আইডি ছাড়াও ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যরিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী লীগ নেতা আফম বাহাউদ্দিন নাসিম, যুবলীগ সভাপতি শেখ ফজলে সামস পরশ, সংসদ সদস্য রেহেনা বেগমসহ অনেকের নামে ভুয়া আইডি পাওয়া গেছে।
আর এসব আইডি ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
এছাড়াও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটিএম কার্ড জালিয়াতি, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা, ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ব্লাকমেইলিং, নারী ও শিশুদের হয়রানিসহ সব ধরনের সাইবার অপরাধ বেড়েই চলেছে। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে হিমছিশ খাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তাই সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় তিনটি আলাদা ইউনিট করেছে পুলিশ। এরমধ্যে ডিএমপির অধীনে কাজ করছে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন এবং সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার।
ডিএমপির তথ্যমতে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সাইবার অপরাধ বেড়েছে। রাজধানীর ৫০ থানায় ২০১৯ সালে সাইবার অপরাধের মামলা হয়েছে ২৮৪টি এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭১ জন। ২০২০ সালে মোট মামলা হয়েছে ৩১৭টি এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৮৪ জন।
রাজধানীতে গড়ে প্রতিমাসে সাইবার অপরাধের ৩০টি করে মামলা হচ্ছে। সম্প্রতি মামলার সংখ্যা আরও বেড়েছে। অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে মামলা হয়েছে ৩৯ ও ৪২টি।
এদিকে, সাইবার ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে সাইবার অপরাধে মামলা হয়েছে ২৩০৮টি। এরমধ্যে বিচারাধীন রয়েছে ২,১১৬টি মামলা। আর নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯১টি। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ১২টি মামলা। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত হয়েছে ৩২ মামলা।
সাইবার অপরাধকে সামনের দিনগুলোতে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ কামরুল আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অপরাধ ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতা একসঙ্গে চলে। এই দুইটার মধ্যে যখন কিছুটা গ্যাপ তৈরি হয়, তখন মনে হয় অপরাধ কিছুটা বেড়েছে।'
'বর্তমানে লো টেক সাইবার অপরাধ বেশি হচ্ছে। হাইটেক অপরাধ তেমন হচ্ছে না। রেগুলোর অপরাধে কী হতো? অপহরণ। অপহরণের উদ্দেশ্য কী? টাকা নেওয়া। টাকার জন্যই সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছে অপরাধীরা। অপরাধীরা মানুষের ইমোশনকে ব্যবহার করে এসব অপরাধ করছে,' যোগ করেন তিনি।
কামরুল আহসান আরও বলেন, 'অপরাধ দমনে আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি।'
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, প্রযুক্তি ব্যবহারে অসচেতনতা, সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হওয়ার শঙ্কা এবং দোষীদের শাস্তি না হওয়াসহ নানা কারণে সাইবার ক্রাইম বেড়ে চলছে।
সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে, সাইবার অপরাধে আক্রান্ত মাত্র ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ দায়েরের জন্য আইনি সহায়তা নেন। দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে সঠিক আইনের আওতায় এনে শাস্তি চান ৪৪ শতাংশ ভুক্তভোগী। ২৩ শতাংশ ভিকটিম পুনরায় যৌন হয়রানির ভয়ে আইনের দ্বারস্থ হতে ভয় পান। ২৩ শতাংশ ভিকটিম পত্রিকায় ছাপা হওয়ার ভয়ে আইনি সহায়তা নিতে ভয় পান। ১৭ শতাংশ ভিকটিম তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করতে চান না। ৩০ শতাংশ ভিকটিম জানেনই না অনলাইনে যৌন নির্যাতনের শিকার হলে কীভাবে আইনি সহায়তা পেতে পারেন। আর ২৫ শতাংশ ভিকটিম কোনো ইতিবাচক ফল আসবে না বিধায় কোনো অভিযোগ করতেই চান না।
আসকের সিনিয়র উপ-পরিচালক নিনা গোস্বামী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সাইবার অপরাধ বাড়ছে। তাই বলে আমরা তো প্রযুক্তি ব্যবহার কমাতে কিংবা বাদ দিতে বলতে পারি না। বিশ্বের সাথে তাল মিলাতেই প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ছে। অপরাধ কমাতে হলে ইন্টারনেট ব্যবহার নিরাপদ করতে হবে, যেটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করছে।'
'কী ব্যবস্থা নিলে শিশুরা খারাপ সাইটগুলো ঢুকতে পারবে না, সেটা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নিশ্চিত করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি ও নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে সাইবার অপরাধ কমে আসবে,' যোগ করেন তিনি।