ডেঙ্গু সংক্রমণের ভীতি বেড়েই চলছে, হাসপাতালে বাড়ছে ভিড়

রাজধানীর বংশালের বাসিন্দা মকবুল হোসেন তার সাত বছরের সন্তানসহ প্রায় তিনদিন জ্বরে ভোগার পরে গত ৫ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু পরীক্ষা করান। ফলাফলে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ায় পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হন তারা। এখানে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ১০০টিরও কম শয্যা বরাদ্দ থাকায় ডেঙ্গু ওয়ার্ডের মেঝেতেই থাকতে হচ্ছে তাদের। ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকায় অনেকেই আছেন মেঝেতে।
মকবুল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ঢাকায় ডেঙ্গু সমস্যা নতুন কোনো বিষয় না। ২০১৯ সালেও আমার স্ত্রী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন তা বেশ ভুগিয়েছিল আমাদের। এবছর আমি আক্রান্ত হলাম মেয়েকে নিয়ে। আমার প্লাটিলেট সংখ্যা কিছুটা কমেছিল, এখন অনেকটা ঠিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, মেয়ের অবস্থা বেশি খারাপ। মেয়ের অবস্থা ভালো হলে আমরা বাসায় বসে চিকিৎসা নিতাম। এখানে এতো মানুষের মধ্যে আমার সঙ্গে থাকা পরিবারের লোকজনও ভয়ে থাকে যে, তারা আবার কখন আক্রান্ত হয়ে যায়।"
মকবুলের বাসার আশপাশে রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং সবসময়ই পানি জমে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "বর্ষার সময় সিটি করপোরেশন খোঁড়াখুঁড়ি করে যেমন মানুষের চলাচলে ভোগান্তির সৃষ্টি করে, তেমনি ডেঙ্গুসহ নানা রোগের সংক্রমণ ছড়ায়। আমার বাসার আশপাশের অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।"
শুধু মকবুলই নয় ডেঙ্গু সমস্যা রাজধানীবাসীকে বেশ ভোগাচ্ছে। দুই সিটি কর্পোরেশন এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসে এবং যারা বাড়ির আশপাশ পরিস্কার রাখছে না সেখানে অভিযান চালিয়ে প্রতিদিন লাখ টাকার উপরে জরিমানা করলেও ডেঙ্গু থেকে রেহাই পাচ্ছে না নগরবাসী।
এদিকে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকার ৫টি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা করার দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও কেবল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চালু হয়েছে।
বাকি চারটি হাসপাতালে এখনো ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়নি। এসব হাসপাতালের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও সরঞ্জামাদি চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে এখনো এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। ফলে এ চার হাসপাতালে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে চিকিৎসা শুরু করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ চারটি ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে কমলাপুরের রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনো ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা পায়নি। মিরপুর লালকুঠি মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গর্ভবতী নারী ও নবজাতক শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়, কিন্তু ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা শুরু করেনি হাসপাতালটি। কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতাল ও আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতালেও শুরু হয়নি ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা।
গত ২৫ জুলাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঢাকার এ হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. কাজী মো. রাশিদ উন নবী টিবিএসকে বলেন, "আমাদের এখানে ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রথম থেকেই সাধারণ রোগীর সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য যে ওয়ার্ড করা হয়েছে সেখানে ৮০ জন রোগী ভর্তি করা সম্ভব, কিন্তু এ ওয়ার্ড ব্যতীত অন্য ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "আমাদের এখানে গতকাল পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৪০০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন, সেখানে ডেঙ্গু রোগী ছিলেন ২২৮ জন। ৫০ বেডের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ১৭৪ শিশু, যাদের মধ্যে ৪০ জন ডেঙ্গু রোগী। এছাড়া মেডিসিন, গাইনি ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।"
এখন ডেঙ্গু রোগীরা বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় ভর্তি না হয়েই প্রাথমিক অবস্থায় ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে মৃত্যু কম হচ্ছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
বর্তমানে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছরের রোগীর সংখ্যাই বেশি। গত সাত দিনে বিভিন্ন হাসপাতালে ২১ থেকে ৩০ বছরের ৪৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন । এছাড়া, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ৪১৫ জন এবং এক থেকে ১০ বছরের মধ্যে ৪২২ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৪৮ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ মাসের প্রথম ১০ দিনেই ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৮৯৯ জন। এ বছর মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৫৫ জনে। চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন ১১ হাজার ৯৮০ জন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ বছর মোট ৫৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এ মাসের প্রথম ১০ দিনে মারা গেছেন আট জন।
বর্তমানে ঢাকার ৪১টি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী এ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন এক হাজার ৪১ জন এবং রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৮০ জন ডেঙ্গু রোগী।
আগামী দুই-এক সপ্তাহ পর ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমতে শুরু করবে উল্লেখ করে ঢাকা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "যখন একটি রোগীর সংক্রমণ বেড়ে যায়, তখন মানুষের মধ্যে জানাজানি হওয়ায় মানুষের মধ্যে সতর্কতা বেড়ে যায়। ফলে, প্রাথমিক অবস্থায়ইে এখন অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাই এখন রোগীরা কম ঝুঁকিতে থাকছেন। পূর্বের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় এক সপ্তাহ কিংবা দুই সপ্তাহ পরে সংক্রমণ কমতে শুরু করবে।"
স্কুলগুলোতে যদি প্রথম থেকেই এডিস মশা মুক্ত করতে সিটি কর্পোরেশন সচেতন হতো তাহলে সংক্রমণ অনেকটাই কম হতো উল্লেখ করে এ কীটতত্ত্ববিদ বলেন, "ডিএনসিসি এখন যেভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফগিং করে মশা মারছে সেটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। তবে এ ব্যবস্থা বছরের প্রথম থেকেই নিলে সংক্রমণ আরও নিচে রাখা যেত।"
তিনি আরও বলেন, "ডাব্লিওএইচও যেসব সতর্কতা জারি করেছিল, সেগুলো মানলে দেশের ডেঙ্গু সংক্রমণ এতো বাড়ত না। শুধু ফগিং করলেই হবে না। তিনদিন পর পর যদি একটি জায়গায় ফগিং করা হয়, তবে পুরো শহর টক্সিক হয়ে যাবে তখন অন্য সমস্যা দেখা যাবে। তাই এডিস দমনে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় কাজ করতে হবে। দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "এখন কোভিড কমে গিয়েছে। তাই সাধারণ হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থা বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য সরকার কাজ করছে।"
"এখন যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে সেটা চলমান থাকলে সেপ্টেম্বরেও সংক্রমণ কমবে কি না বলা যাচ্ছে না। এজন্য সিটি করপোরেশনের এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের দিকে আরও নজর দিতে হবে। একইসঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে মশার প্রজনন স্থান ধ্বংস করে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে," বলেন তিনি।
যারা বাসার চারপাশ পরিষ্কার রাখবে না এবং এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হবে না, তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগেরও পরামর্শ দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এই পরিচালক।