সংসদ ভবনের ফুটপাতে সুলাইমানের ৩০ টাকার বই!

সময় তখন বিকেল পাঁচটা কুড়ি বা পঁচিশের এদিক-ওদিক। কিন্তু পড়ন্ত বিকেলেও সংসদ ভবনের লেক রোডে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। শুক্রবার বলে হয়তো সেটা অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশিই। অবশ্য ভিড়ের মধ্যেও বিকেলটা বেশ উপভোগ্য ছিল বলতে দ্বিধা নেই। শীতের শেষ আর বসন্তের শুরুর সন্ধিক্ষণ-এমন বিকেলের আবহটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে, মন ভারী হয়ে থাকে। তবুও কোথাও যেন এক অজানা আনন্দও খেলা করে।
এই আবহের রেশ ধরেই সেদিন চন্দ্রিমা উদ্যানে খানিক সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। তবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কিছুটা প্রশান্তি পাওয়া গেলেও ক্লান্তি যেন সহজে পিছু ছাড়েনা। তাই ঘণ্টা দুয়েক পরে ঘরে ফেরার রাস্তা ধরলাম। সংসদ ভবনের সামনের রাস্তার চওড়া ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম।
পথে চলতে চোখ পড়লো সারি সারি বিভিন্ন রকম খাবারের দোকানের দিকে। কেউ বিক্রি করছেন গরম গরম পিৎজ্জা, কেউ কেক, কেউ-বা দেশীয় পিঠা। আবার কোথাও হালিম-চটপটির বিশাল আয়োজন। মনে পড়ে গেল, কয়েক মাস আগেও এই রাস্তায় এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যেত না। তবে এখন যেন এক ভিন্ন চিত্র। রাস্তার ধারে দোকানগুলোতে মানুষের জমায়েতও কম নয়। ছুটির দিন বলে বোধহয় আরও বেশি ভিড় জমেছে। কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে খাবার খাচ্ছেন, কেউ আবার খাবারের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন।
তাদের দেখে ইচ্ছে হলো, এমন হালকা শীতল বাতাস বুলিয়ে যাওয়া বিকেলে এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। ভাবনা মোতাবেক ফুটপাতের পাশে ছোট্ট এক চায়ের টং-এ বসে পড়লাম। মামা লাল চা বানালেন যত্ন নিয়ে, আর সেই চায়ের ওপরে সাদা তিল আর কালো জিরার ছিটা যেন অমৃত করে তুললো স্বাদ। অবশ্য এমন চায়ের স্বাদ নেওয়া প্রথমবার নয়। আগেও খেয়েছি বহুবার। তবে এবার যেন আলাদাই মনে হলো। আয়েশ করে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতেই হঠাৎই নজর পড়লো একটু দূরে সাজিয়ে রাখা একটি কাঠের বুকশেলফের ওপর।
ছয়-সাতজন তরুণ সেখানে ভিড় জমিয়েছেন। কেউ বই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছেন, কেউ আবার একসঙ্গে তিন-চারটি বই কিনে নিচ্ছে ন। দ্রুত চা শেষ করে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। দোকানের কাছাকাছি এগোতেই দেখলাম, শুধু শেলফ নয়, ফুটপাতের এক পাশে কাঠের তক্তায় ধাপে ধাপে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আরও অনেক বই। উপর দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি ছোট্ট সাইনবোর্ড—'৩০ টাকা মাত্র!'

এই দামে বই? অবাক হলাম বেশ। কৌতূহল দমাতে না পেরে দোকানি সুলাইমানের সঙ্গে কথা বললাম মিনিট তিরিশের মতো। তার পুরো নাম মো: সুলাইমান। থাকেন ঢাকার সোবহানবাগে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে অনেক বছর ধরেই সেখানে বাস করছেন তিনি। বয়স চল্লিশের বেশি। সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায় বসে বই বিক্রি করছেন প্রায় আট বছর ধরে। এই কাজের প্রতি তার ভালোবাসা তৈরি হয়েছে ছোট ভাইকে দেখে। ছোট ভাই বই বিক্রি করতেন, তাকে দেখেই এক সময় সুলাইমানও বই বিক্রির পেশায় আসেন।
কথা বলার মাঝেও বেশ ব্যস্ত সময় পার করছিলেন তিনি। ক্রেতাদের কেউ কেউ হাজার প্রশ্ন করলেও বিরক্ত হচ্ছেন না মোটেও, বরং হাসিমুখে সবার জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। এই কারণেই হয়তো তার ক্রেতাও বেশি।
সুলাইমানের বইয়ের দোকানটিতে পথচলতি মানুষেরা একবার করে হলেও থামছেন। নেড়েচেড়ে বই দেখছেন। কেউ কেউ আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বইয়ের পাতায় ডুবে যাচ্ছেন। এই দোকানে পুরনো বই, গল্প-উপন্যাস, কবিতা, আত্মউন্নয়নমূলক লেখা, একাডেমিক বই—সবকিছুরই ধরণ আছে। সুলাইমান জানালেন, এতসব বইয়ের ভিড়ে পাঠকদের পছন্দের শীর্ষে এখনও ফিকশন বই। প্রায় সবাই এসে উপন্যাস বা গল্পের বই-ই বেশি কেনেন।
প্রতিদিন বিকেল বেলা সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায় বই নিয়ে বসেন তিনি। তবে শুধু রাস্তার দোকান নয়, অনলাইনেও পাওয়া যায় তার বই। 'সুলাইমান বুক' নামে একটি ফেসবুক পেইজ আছে তার। তবে অনলাইনে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন, ভাবেন এত কম দামে বই মানেই কিছু সমস্যা আছে, হয়তো ছেঁড়া বা নকল বই। কিন্তু সুলাইমান স্পষ্ট করে বলেন, "আমি ছেঁড়া বা নকল বই বিক্রি করি না।"

সুলাইমান তার বইগুলো তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন। কিছু বই ৩০ টাকা, কিছু ৫০ টাকা এবং কিছু ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করেন।
৩০ টাকায় বই বিক্রির পেছনে রয়েছে তার নিজস্ব কৌশল। শোনালেন সে গল্পও। তিনি জানান, প্রথমে বইগুলো ডিসপ্লেতে রাখেন। সেখানে বিক্রি না হলে কিংবা দীর্ঘদিন ধরে অবিক্রিত থাকলে, সে বইগুলো ৩০ টাকায় বিক্রি করে দেন। এতে করে ডিসপ্লেতে নতুন বই রাখার জায়গা তৈরি হয় এবং পুরনো বই দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। আবার নতুন বইয়ের সংগ্রহ আনতে সুবিধা হয়।
এতে লস হয় না? সুলাইমান আত্মবিশ্বাসী গলায় বলেন, "না, কোনো লস হয় না। কমপক্ষে ১০ টাকা লাভ থাকেই। আমি এত বছর ধরে এই কাজ করছি, কীভাবে ব্যবসা চালাতে হয় তা জানি।"
আবার জানালেন তার বইয়ের বিক্রিও নাকি বেশ ভালো হয়। প্রতিদিন গড়ে ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা লাভ করেন তিনি। তরুণ ছেলেমেয়েরা এই পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কালে একটি করে হলেও বই কিনে নেন। যারা তার পুরোনো ক্রেতা তাদের কেউ কেউ আগেই বলে রাখেন ঠিক কোন বই চাই তাদের। সুলাইমান সে মোতাবেক এনেও দেন।

সুলাইমান এসব বইয়ের বেশিরভাগই নিয়ে আসেন নীলক্ষেত থেকে। নীলক্ষেতের অনেক বিক্রেতা লটে বই বিক্রি করেন, যেখানে একসঙ্গে ৫০০ বা এক বাজার পরিমাণ বই কম দামে পাওয়া যায়। সুলাইমান এভাবে লটে বই কিনে নেন। আবার নেওয়ার সময় হিসাব করেন, কত সংখ্যক বই ৩০ টাকায় বিক্রি করা যাবে, কত বই ৫০ বা ১০০ টাকায় বিক্রি হবে। এভাবেই তিনি দাম নির্ধারণ করেন এবং লাভের অঙ্ক ঠিক করেন।
এছাড়াও, তার দোকান থেকে বই কিনে কেউ চাইলে আবার তাকে সে বই বিক্রিও করতে পারেন। অনেকেই পুরোনো বই জমা করে নিয়ে আসেন, বিক্রির উদ্দেশ্যে। সুলাইমান সেগুলো কিনে নতুন ক্রেতাদের কাছে আবার বিক্রি করেন। এটিও কম দামে তার বই প্রাপ্তির আরেকটি উৎস।
তবে শুরতেই এত কমে বিক্রি করতেন তা নয়। এই ভাবনার পেছনের গল্পও শোনালেন মিনিট কয়েক ধরে। একদিন তিনি এক গরুর মাংস বিক্রেতাকে দেখলেন, যিনি অন্যদের তুলনায় কম দামে মাংস বিক্রি করছিলেন। ওই বিক্রেতা ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করতেন, যেখানে অন্যরা ১৫০-২০০ টাকা বেশি দাম রাখত। কিন্তু ওই ব্যক্তি কম দামে বিক্রি করায় তার বিক্রি বেশি হতো এবং লাভও ভালো হতো। সুলাইমান সেই ব্যবসায়িক কৌশলটি নিজের বই বিক্রির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা শুরু করেন।
"কম দামে বিক্রি করলে বেশি সংখ্যক বই বিক্রি করা যায়, ফলে লাভও বেশি হয়," বললেন তিনি।
সুলাইমানের এই বই বিক্রির পদ্ধতি অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণার বিষয় হতে পারে। সীমিত লাভ রেখে বেশি পরিমাণ বিক্রির মাধ্যমে তিনি প্রতিদিনের আয় নিশ্চিত করেন, পাশাপাশি পাঠকদেরও কম দামে বই কেনার সুযোগ করে দেন। এই যেমন, তার সংগ্রহে থাকা বইগুলো প্রতিদিন নতুন কোনো পাঠকের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে, আর জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।

তাছাড়া, ফুটপাতের মতো এমন একটা জায়গায় এত কম দামে বই বিক্রির এই উদ্যোগ বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। যে তরুণরা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের চোখেও আলাদা উচ্ছ্বাস। এদের কেউ হয়তো তার প্রিয় লেখকের পুরনো সংস্করণ পেয়ে উচ্ছ্বসিত, কেউ আবার নতুন কোনো বিষয় জানার আশায় কিনে নিচ্ছেন কোনো বই।
সেদিন সুলাইমানের সাথে আলাপকালে মনে হলো, বিকেলের এই ঘোরাফেরা নিছক ক্লান্তির বদলে এক অন্যরকম প্রশান্তির গল্প হয়ে থাকল। পকেট থেকে ১০০ টাকা বের করে তিনটি বই কিনে নিলাম আমিও। শরৎচন্দ্রের 'দেনা পাওনা', শেক্সপিয়ারের 'টুয়েলফথ নাইট' এবং সুনীলের 'পূর্ব-পশ্চিমে' (প্রথম খন্ড)।