সকাল থেকে রাত: যেমন চলে বাইক রাইডারের জীবন

বাবা ফিরে না আসা পর্যন্ত মুনতাহা ঘুমায় না। মোস্তফা মীরের ছোট মেয়ে মুনতাহা। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। মীরের বাসায় ফিরতে রাত এগারোটা বা বারোটা পর্যন্ত লেগে যায়। মুনতাহার স্কুল শুরু হয় সকাল সাতটায়। তবু সে বাবার সঙ্গে কিছু না খেয়ে ঘুমাতে যায় না।
মীর একজন পার্ট-টাইম বাইক রাইডার। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। বাড়ি যশোরে। তার বড় মেয়ে ক্লাস সিক্সের ছাত্রী।
ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে ওঠেন মীর। নামাজ পড়ে মেয়েদের স্কুলের প্রস্তুতি করিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে সাড়ে আটটা পর্যন্ত বিশ্রাম নেন। তারপর গোসল সেরে নাস্তা করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হন। দশটার কিছু আগেই তিনি প্রাইভেট একটি অফিসের অ্যাডমিন বিভাগে পৌঁছে যান।
সারাদিন কাজের পর সন্ধ্যা ছয়টায় বাইক নিয়ে বের হন রাইড দিতে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে তিনি বাজাজের পালসার বাইকটি কেনেন। এখন পর্যন্ত ৩৬ হাজার কিলোমিটার চালিয়েছেন। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত সব খরচ বাদ দিয়ে তার আয় হয় ১০০০ টাকা। খরচ বলতে তেল ও মবিলের ব্যয় এবং মাঝে মাঝে চা-নাস্তা।
যদি রাস্তাঘাট ভালো থাকত
ঢাকার রাস্তাঘাট ভালো হলে মীরের ইনকাম অন্তত দেড়গুণ বাড়ত। জ্যামের পাশাপাশি ভাঙাচোরা রাস্তা, কাটাকুটি, পানি জমে থাকা, পথচারীদের ইচ্ছেমতো পারাপার—সব মিলিয়ে বাইক চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।
মোস্তফা মীর বললেন, 'ঢাকায় মানুষ আসে বিপদে পড়ে। এত ধোঁয়া, ধুলা ও আবর্জনার মধ্যে বেঁচে থাকা কষ্টের। আমাদের যশোর অনেক পরিচ্ছন্ন, বারো মাস শাক-সবজি পাওয়া যায়, ইচ্ছেমতো সাঁতার কাটা যায়, জীবনযাপনের খরচ কম। কিন্তু ঢাকায় জীবিকার উপায় বেশি। তাই বাধ্য হয়েই মানুষ এখানে আসে।'

বাইক রাইডিং করে মীরের মাসের বাজার খরচ উঠে যায়। ষোল হাজার টাকা বাসা ভাড়া, খাবার খরচ ১৫ হাজার টাকা, দুই মেয়ের পড়ার খরচ সাড়ে চার হাজার টাকা, চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় তিন হাজার টাকাসহ মোট খরচ প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। বাড়িতে মাকেও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। তিনি মাসে ১৮-২০ দিন বাইক চালান।
শুক্র ও শনিবার বাইক নিয়ে বের হলে মেয়েরা অভিমান করে। তারা চায়, বাবা অন্তত দুই দিন তাদের সঙ্গে কাটাক। তবে সবসময় সম্ভব হয় না, কোনো কোনো মাসে প্রয়োজন বেশি হলে তাকে বেশি সময় বাইক চালাতে হয়।
মোস্তফা মীর মাঝে মাঝে পরিবার নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যান। ফেব্রুয়ারি মাসের এক শনিবার কচুক্ষেতের থাই গার্ডেনে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ভাগ্নে ও ভাগ্নের স্ত্রী। সব মিলিয়ে বিল হয়েছিল আড়াই হাজার টাকা।
মীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। জানতে চাইলাম, পরিচিত কেউ দেখে ফেললে লজ্জিত হন কি না?
মীর বললেন, 'লজ্জা কিছু পাই তবে আড়াই–তিন বছরে সয়ে গেছে। খুব নিকটাত্মীয় কেউ দেখে ফেললে বলি, এই তো কলিগের জন্য অপেক্ষা করছি। আসলে প্রয়োজন যখন প্রধান হয়ে ওঠে, তখন অন্য কিছু খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।'
মীরের কাছে ঢাকার সবচেয়ে খারাপ রাস্তা হলো বাড্ডা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড।
মীরের সঙ্গে কথা হয়েছিল রাত সাড়ে দশটায়, তার বাসায় ফেরার সময়। কমলাপুর থেকে ২৫০ টাকা ভাড়ায় শেষ প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন, তাই কথা বলার সুযোগ পেলাম।
শেষে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নারীরা কি আপনাদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? তিনি বললেন, 'হ্যাঁ, করেন। সাধারণত রাইডাররা বিনয়ী ও ভদ্র হন। নারীরাও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করেন।'

মোস্তফা মীরকে শুভকামনা ও ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
পরদিন ১০ নম্বর
পরদিন সকালে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে গেলাম। এটাকে বলা যায় বাইকার স্টেশন। কমপক্ষে ১০ জন রাইডার বসে আছেন যাত্রীর অপেক্ষায়।
একজনের নাম মামুন মোল্লা, বয়স ৩২, বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তিনি আমের ব্যবসা করতেন, কিন্তু করোনার পর ব্যবসায় ধস নামে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়েছিলেন। তাই সব গুটিয়ে দুই বছর আগে ঢাকায় চলে আসেন। সঙ্গে বাইকটি নিয়ে আসেন।
প্রথম দুই মাস তার কষ্ট হয়েছে। কথায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের টান থাকায় সবাই বুঝে ফেলত, তিনি নতুন। তখন প্যাসেঞ্জার যা ভাড়া বলত, তাতেই রাজি হতেন, জায়গা চেনা জরুরি ছিল। তবে দুই মাস পর সব আয়ত্তে চলে আসে।
মামুনের পরিবার বাড়িতেই থাকে, তিনি ঢাকায় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মেসে থাকেন। ছয় বা নয় মাসে একবার বাড়ি যান। তিনি পেশাদার বাইকার, দিনে ৮-১০ ঘণ্টা বাইক চালান।
বললেন, 'সকাল ৮টা থেকে ১১টা এবং বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা হলো বাইকারদের পিক আওয়ার। মাঝখানে বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিই, খাবার খাই।'
জিজ্ঞেস করলাম, আর কতদিন এ পেশায় থাকবেন? মামুন বললেন, 'চার-পাঁচ বছরের বেশি এ কাজে থাকা যায় না, শরীর সায় দেয় না। তাই এ সময়ের মধ্যে কিছু পুঁজি জোগাড় করে অন্য পেশায় যেতে হবে।'

শরীরে ব্যথা হয়
মামুনের পাশেই ছিলেন হাসান আহমেদ। নিজেই ডেকে বললেন, 'একটি দুঃখের কথা বলি ভাই, সবাই সব দোষ আমাদের দেয়, অথচ ফুটপাথে হকার বসে, রাস্তায় মিছিল হয় কিন্তু পুলিশ কাউরেই কিছু বলে না। আমাদের ২০০০ টাকার মামলা দিয়ে দেয়। এক মামলায় দুই দিনের কামাই শেষ।'
হাসান একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। আগে এক ডেভেলপার কোম্পানিতে কাজ করেছেন, কিন্তু কোম্পানিটি লোকসান গুনে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে কাজ খোঁজার পাশাপাশি বাইক চালাচ্ছেন তিনি।
রোজগার মন্দ হয় না, তবে কষ্ট হয় অনেক বেশি, বিশেষ করে হাত ব্যথা করে। ঝাকুনি লাগায় শরীরেও নানারকম অসুবিধা হয়। সবদিক খেয়াল করে চলতে হয়, বিশেষ করে চোখের ব্যবহার করতে হয় বেশি।
হাসান বললেন, 'এ পেশায় যারা আসবে তাদের সুস্থ থাকা লাগবে, আর বয়সও বেশি হলে চলবে না। আরেকটি জিনিস থাকতে হবে, তা হলো বিনয়। প্যাসেঞ্জার বিরক্ত হবে, দুচারটে কটু কথা বলবে, কিন্তু আপনাকে উত্তর দিতে হবে বিনয়ের সঙ্গে।'
হাসানের বাড়ি মাতুয়াইলে, ঢাকাতেই বড় হয়েছেন, তবু গুলিস্তান এলাকা তার খুবই অপছন্দের। পারতপক্ষে ওই দিকে প্যাসেঞ্জার তুলতে চান না। হাসান চিন্তা করে পান না, কেন কর্তাব্যক্তিরা সবকিছুকে ঢাকাকেন্দ্রিক করে তুলছেন। এমন অবস্থা তৈরি হলে মানুষ তো হাঁটতেও পারবে না। তিনি শুনেছেন, ঢাকায় মোটরবাইকের সংখ্যা না-কি ৬০ হাজার!
আলী অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন
মিরপুর ১০ নম্বর থেকে শিকড় বাসে করে এসে নামলাম কারওয়ানবাজার। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে দেখি, সোনারগাঁও হোটেলের সামনে ৪-৫ জন বাইকার দাঁড়িয়ে আছেন।
একজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ চাইলাম। তিনি পরিচয় পেয়ে রাজি হলে গেলেন। মোহাম্মদ আলীর বয়স ৩৭। জীবনের শুরুতে তিনি কাজ করেছেন একটি এনজিওতে। অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। ফ্যানের নিচে বসে ডেস্কে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতেন।

বাইক চালানোর তুলনায় সেটা ছিল অনেক আরামের, কিন্তু ধর্মীয় দিক থেকে নিজের ব্যক্তিগত নৈতিক দর্শনের কারণে সে চাকরি ছেড়ে দেন। পরে আরও দু-একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, তারপর পুরোদস্তুর বাইকার হয়ে গেছেন।
তিনি একটু নাজুক শরীরের মানুষ। সাধারণত ধুলো-বালি বেশি আছে, তেমন রাস্তায় যান না। রেইনকোট, মাস্ক না নিয়ে বের হন না।
বললেন, 'এ কাজে খুব ধৈর্য থাকা লাগে। কোনো কোনো সময় দু-তিন ঘণ্টা শুধু বসে থাকতে হয়, আবার দু-তিন ঘণ্টায় হাজার টাকাও রোজগার হয়ে যায়। সবই সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে।'
মিষ্টির কারিগর থেকে বাইকার
মিয়া মো. হাফিজ মিষ্টির কারিগর ছিলেন। ভালো মিষ্টি বানানোর দক্ষতা তার ছিল। কিন্তু একসময় মিষ্টিতে তার অ্যালার্জি দেখা দিল। মিষ্টির গন্ধও সহ্য করতে পারেন না।
চাচাত ভাইয়ের কাছে জানতে পেরেছিলেন, মোটরসাইকেল চালাতে পারলে ঢাকায় কাজ আছে। অল্পদিনেই শিখে নিয়েছিলেন বাইক চালানোর উপায়।
তারপর ঢাকায় এসে চাচাত ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন। তিনি দেখলেন, এটি অদ্ভুত পেশা। বাইক নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াও, প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে দরাদরি করো, আর বনিবনা হলে চলতে শুরু করো।
কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করে না, কারও কাছে কোনো জবাবদিহি লাগে না। হাফিজ জানালেন, যতদিন শরীর সয়, ততদিন এ কাজ করে যাবেন।

বাংলা কলেজের সবুজ
বাংলামোটরে এসে সবুজকে পেলাম। বয়স হবে ২৫। সে বাংলা কলেজে পড়ে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাইক চালায়।
রাইড দিয়ে যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে নিজের থাকা-খাওয়া, বই-পত্র কেনা, পকেট খরচ চালায়। নিজেকে বেশ স্বাধীন ও স্বনির্ভর মনে হয় তার। কারও মুখাপেক্ষী হতে হয় না বলে কাজটি তার খুব ভালো লাগে।
তবে একটু হুশ থেকে চালাতে হয়। গাড়ির গতি ৫০-৬০ এর বেশি না হওয়াই ভালো। বিশেষ করে হাইরোডে উঠলে গাড়ি যেন বাতাসের গতি পায়, সেটা রুখতে হবে।
আর কিছু খারাপ পথ আছে, যেমন পূর্বাচল বা বনশ্রীর পেছনের দিক। দুষ্টু লোকেরা সেখানে নিজেদের পছন্দমতো পথে নিয়ে যেতে চায়, আর পরে তার ঘাপটি মেরে থাকা সঙ্গীরা ঘিরে ধরে মোটরসাইকেলও নিয়ে যায়।
'যারা নতুন আসে, তাদের গলি-ঘুপচিতে না যাওয়াই ভালো,' বলে সবুজ।
রাইডাররা কেন পাঠাও বা উবার-এর মতো রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের আওতায় বাইক চালাতে চান না? জানতে চেয়েছিলাম মো. আলীর কাছে। আলী বললেন, 'এতে ইনকাম কমে যায়।'
তিনি হিসাব করে দেখালেন, ৭ কিলোমিটার পথে চুক্তিভিত্তিতে আয় কম করেও ১৩০ টাকা, অথচ পাঠাওতে পাওয়া যায় নব্বই টাকার কাছাকাছি। প্রায় ২০ ভাগ টাকা কাটা যায়।
'তাই কেন অ্যাপে গাড়ি চালাব? কেবল দুপুরে যাত্রীর চাপ না থাকলে অ্যাপের কাস্টমার ধরি,' বলেন তিনি।
প্রায় ১০ বছর হলো ঢাকায় পেশা হিসাবে দাঁড়িয়েছে বাইক রাইডিং। এতে পার্ট-টাইমার যেমন আছে, ফুল-টাইমারও আছে। স্বাধীন পেশা হিসাবে এর গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ছে।