কাস্টমাইজ টাইপোগ্রাফিক ফন্ট তৈরির দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশি ব্র্যান্ডগুলো

আপনি কখনো ভেবে দেখেছেন কেন কিছু কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখতে খুব আলাদা মনে হয়? কেন অ্যাপল কিংবা গুগলের ব্র্যান্ডিংয়ের আউটলুক বেশ অনন্য? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এমন সব বড় ব্র্যান্ডগুলো প্রত্যেকেই নিজেদের টেক্সটে এক স্বতন্ত্র ডিজাইন তৈরি করেছে যা অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম।
টাইপোগ্রাফি ভিজ্যুয়াল ব্র্যান্ডিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোম্পানিগুলি প্রত্যেকেই নিজেদের অনন্য পরিচয় তৈরি করতে চায়। এক্ষেত্রে বহু কোম্পানি একটি কাস্টমাইজ টাইপফেস তৈরিতে বিনিয়োগ করে; যা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ড থেকে আলাদা করে।
টাইপফেস মূলত ফন্ট ফ্যামিলি হিসেবে পরিচিত; যেখানে থাকে একগুচ্ছ অক্ষর ও প্রতীক। এগুলো ডিজিটাল কিংবা প্রিন্টিং ফরম্যাটে লেখার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে এখন কাস্টমাইজ টাইপফেস জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
কোম্পানিগুলো টাইপফেসে কেন বিনিয়োগ করছে?
কাস্টমইজ টাইপফেস একটি ব্র্যান্ডকে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ড থেকে আলাদা করে নিজস্ব পরিচয় তৈরিতে সাহায্য করে। যদিও ব্র্যান্ডিং শুধু টেক্সের ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং একটা সামগ্রিক বিষয়। তবে টাইপফেস একটি সূক্ষ্ম ডিটেইল যোগ করে; যা ব্র্যান্ডের সামগ্রিক অভিব্যক্তিকে তুলে ধরে।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং বই প্রকাশকেরা কাস্টমাইজ ফন্ট সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে প্রিন্ট পেপারের একটি ছেড়া অংশ দেখেও বোঝা যাবে যে, সেটি কোন প্রতিষ্ঠানের। এক্ষেত্রে কোম্পানির নাম না লেখা থাকলেও চলবে।
ঢাকা ভিত্তিক দক্ষ টাইপফেস ডিজাইনার জ্যাকব থমাস বলেন, "শক্তিশালী ব্র্যান্ডিং তৈরিতে টাইপফেসের অসাধারণ ও নেপথ্য ভূমিকা রয়েছে। এটি মূলত টাইপটি কতটা সর্বব্যাপী ব্যবহার করা হচ্ছে সেটির ওপর নির্ভর করে। সম্ভবত একটি কোম্পানির ভোক্তাদের সাথে যুক্ত প্রায় ৯০ ভাগ ভিজ্যুয়ালে এটি দেখা যায়।"
জ্যাকব 'বাংলা টাইপ ফাউন্ড্রি' এর প্রতিষ্ঠাতা। তারা বেশ সূক্ষ্ম ও স্বতন্ত্র ফন্ট তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানটি সাম্প্রতিক সময়ে আইডিএলসি ফাইনান্স পিএলসির জন্য টাইপফেস তৈরি করে দিয়েছে।
আইডিএলসি ফাইনান্স পিএলসির মার্কেটিং হেড আহামেদ নাজিব রহমান বলেন, "প্রতিটি ব্র্যান্ডের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে; ব্র্যান্ডিংয়ে স্বতন্ত্রতা রয়েছে। একটি কাস্টম ফন্ট ব্র্যান্ডটিকে প্রতিযোগী ব্র্যান্ড থেকে আলাদা করতে পারে।"
নাজিব রহমান আরও বলেন, "পূর্বে আমরা আমাদের ব্র্যান্ডিং ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহজলভ্য ফন্টগুলো ব্যবহার করেছি। এক্ষেত্রে আমরা বাংলা ও ইংরেজি উভয় টেক্সট নিয়ে কাজ করি। তবে উভয় ভাষায় অভিন্ন ডিজাইনসহ দুটি ফন্ট খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফলে আমাদের নিজস্ব ফন্টের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অনুভব হয়।"
জ্যাকব বলেন, "যদিও সচেতনভাবে বেশিরভাগ মানুষই বিভিন্ন রকমের টাইপফেসের নাম জানে না। কিন্তু অবচেতনভাবে তারা প্রায়শই টেক্সটগুলোকে 'ব্র্যান্ডের পরিচিতি' হিসাবে চিনতে পারে কিংবা টাইপফেসের মিলের মাধ্যমে যোগসূত্র বুঝতে পারে।"
জ্যাকবের মতে, কাস্টমাইজ ফন্টগুলো একটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি মূল জায়গায় প্রভাবিত করে। এগুলো হচ্ছে ব্র্যান্ডকে আলাদা করা, ভিজুয়ালে ধারাবাহিকতা ও ব্র্যান্ডের ব্যক্তিত্ব তৈরি করা।
জ্যাকব বলেন, "কর্পোরেটের নানা মূল্যবোধ যেমন নিরাপত্তা, ঐতিহ্য, ট্রেন্ডি, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ইত্যাদি নানা বিষয় প্রকাশ করা যেতে পারে টাইপফেস ব্যবহারের মাধ্যমে।"
অন্যদিকে নাজিব বলেন, "আর্থিক সংস্থা হিসাবে আমাদের কার্যক্রমের মূলে রয়েছে সত্যতা ও গোপনীয়তা। আমাদের অফিসিয়াল নথিতে নিজস্ব ফন্টের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সত্যতার একটি ছাপ রয়েছে।"
ঢাকা-ভিত্তিক আরেক টাইপফেস ডিজাইনার তৌহিদুল ইসলাম হিমেল বলেন, "কাস্টমাইজ ফন্ট একটি ব্র্যান্ডকে প্রকাশে অথেনটিসিটি যোগ করে। এটি ব্র্যান্ডের স্বতন্ত্রতাও প্রকাশ করে।"
হিমেলের প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ফন্ট এক ডজনেরও বেশি ফন্ট ডিজাইন করেছে। যার মধ্যে কিছু ফন্ট সবার জন্য উন্মুক্ত এবং কিছু কর্পোরেট ফন্ট রয়েছে। সম্প্রতি তারা স্মার্টফোন ব্র্যান্ড অপ্পো-এর জন্য একটি কাস্টমাইজ ফন্ট ডিজাইন করেছে।
হিমেল বলেন, "যখন একটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড কোনো অঞ্চল বা দেশে ব্যবসা শুরু করে, তখন এটি সেই অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে তার পরিচয়কে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ার একটি অংশ হচ্ছে যোগাযোগের অনন্য উপায় তৈরি করা। সেক্ষেত্রে কাস্টম টাইপফেস ঐ পথ তৈরি করে দেয়।"
হিমেল আরও বলেন, "বড় ব্র্যান্ডগুলো যেগুলি প্রাথমিকভাবে তরুণদের নিয়ে কাজ করে, তারা টাইপফেস তৈরি করে। কারণ তরুণদের ডিজাইন ও যোগাযোগের ডিটেইলগুলো উপলব্ধি করার সম্ভাবনা বেশি। সেজন্য আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, প্রযুক্তি-সম্পর্কিত অনেক ব্র্যান্ড তাদের নিজস্ব ফন্ট ব্যবহার করছে।"
কাস্টমাইজ ফন্টগুলি সহজলভ্য ফন্টগুলির থেকেও কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে। কেননা সহজলভ্য ফন্টগুলি সবসময় ব্র্যান্ডের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটিয়ে তুলতে পারে না। গ্লোবাল ব্র্যান্ডগুলিকে একাধিক ভাষা নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই এক্ষেত্রে সমস্ত ভাষায় একটি অভিন্ন ধরনের নকশা তৈরি করা আবশ্যক।
টাইপফেস তৈরিতে যা করা হয়
ফন্ট ডিজাইনের প্রক্রিয়া একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ কাজ। প্রতিটি ব্র্যান্ডের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য যোগ করা প্রক্রিয়াটিকে আরও কঠিন করে তোলে।
বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিমেল বলেন, "একটি ফন্ট সেট তৈরি করতে বহু দিন চিন্তাভাবনা, ডিজাইনে পরিবর্তন ও বেটা টেস্টিংয়ের প্রয়োজন হয়। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় একাধিক স্টাইল ও ওয়েট ডিজাইন করতে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪৫ দিনের নিরন্তর প্রচেষ্টার প্রয়োজন।"
হিমেল বলেন, "অবশ্য ব্র্যান্ড যত বড়ই হোক না কেন সব ব্র্যান্ড একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য অর্থ প্রদান করতে সম্মত হয় না। যা বেশিরভাগ ভোক্তাই সক্রিয়ভাবে লক্ষ্য করবে না।"
টাইপফেস ডিজাইন করার সময় প্রতিষ্ঠানের মান, চাহিদা ও আপ্রোচ বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জ্যাকব বলেন, "কাস্টমাইজ ফন্ট তৈরিতে দুটি মূল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একদিকে এটি স্বতন্ত্র ও অরিজিনাল উভয়ই হতে হবে। অন্যদিকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট হতে হবে। এই দুটি দিকের মধ্যে একটি শক্তিশালী সামঞ্জস্য রয়েছে।"
বাংলাদেশে ক্ষেত্রটির সম্ভাবনা
বাংলাদেশে কয়েকটি উদীয়মান ফন্ট তৈরির প্রতিষ্ঠান থাকলেও সাধারণভাবে ফন্ট তৈরি থেকে আর্থিক লাভ কম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ব্র্যান্ডগুলো তাদের নিজস্ব ফন্টগুলি তৈরির প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এছাড়া সহজলভ্য ফন্টের চাহিদাও বাড়ছে।
জ্যাকব বলেন, "মোট কর্পোরেট রাজস্ব ও বিপণন বাজেটের শতাংশ হিসাবে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলি এখনও বৈশ্বিক সফল কর্পোরেট ব্র্যান্ডগুলির তুলনায় কাস্টমাইজ টাইপোগ্রাফিতে অনেক কম ব্যয় করে। অবে আমি মনে করি এই ধারা এখন পরিবর্তিত হচ্ছে। কারণ কোম্পানিগুলি বুঝতে পেরেছে যে, ভিজ্যুয়াল ব্র্যান্ডিংয়ে বিনিয়োগ করা মূল্যবান। তাই ভিজ্যুয়াল ব্র্যান্ডিং আরও বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে এবং সবসময় একটি ছোট কার্যকরী শিল্প হিসেবে থাকবে।"