তারা বাংলাদেশের আয়রনম্যান!

পিঠের প্রচণ্ড ব্যথা টের পেতে বেশি সময় নিলেন না ইমতিয়াজ ইলাহী। ২০০০ সালে সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণে প্যারাস্যুট জাম্পিংয়ের সময়ই দুর্ঘটনাটি ঘটলো। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। জানা গেল মেরুদণ্ডের ৩টি কশেরুকা ভেঙে গিয়েছে, স্পাইনাল কর্ডেও হয়েছে চিরস্থায়ী ক্ষতি, ছিঁড়ে গিয়েছে বেশ কিছু নার্ভ।
দুর্ঘটনার পর মাটিতে পা ফেলতে সময় লাগলো প্রায় ৮ মাস। ডাক্তারদের পরামর্শ: কোনোভাবেই শরীরের ওপর চাপ দেওয়া যাবে না, বিশেষ করে শরীরের নিম্নভাগে। ইঞ্জুরির কারণে বের হয়ে আসতে হলো সেনাবাহিনী থেকেও। তবে নিজেকে সুস্থ আর ফিট রাখার ইচ্ছা কখনোই কমেনি। ধীরে ধীরে শুরু করলেন হাঁটাচলা আর হালকা সাঁতার, সাইকেল চালানোর অভ্যাসটাও ফিরে আসলো কিছুদিন পর। তবে দৌড়ানোর সেই সাহস আর সামর্থ্য তৈরি হতে সময় নিলো পাক্কা আট বছর।
এরও দশ বছর পর ইমতিয়াজ ইলাহীকে দেখা গেল মালয়েশিয়ার দ্বীপ লাংকাউইতে। অংশগ্রহণ করবেন ২০১৮ সালের আয়রনম্যান মালয়েশিয়ায়। না, মারভেলের আয়রনম্যানের মতো লোহার বর্মের সাথে এর কোনো যোগসাজস নেই। তবে যা আছে, তার সাথে কেবল লোহারই তুলনা চলে। কারণ এই চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করতে শরীর আর মনোবলকে লোহার মতোই শক্তিশালী করে তুলতে হয়। আর শেষ করতে পারলে নামের পাশে যুক্ত হয় 'আয়রনম্যান' শব্দটি।
আয়রনম্যানে পরিণত হওয়ার কাহিনীর আগে জেনে নেওয়া যাক কী আছে এই চ্যালেঞ্জে।
আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জের ভেতরে
দিগন্ত চিরে সূর্যের আলো বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরেই খোলা সাগরের তীরে বড় এক ভিড় চোখে পড়বে। সুইমিং গগলস, ক্যাপ আর ওয়েটস্যুট পরা এক হাজার অ্যাথলেট হাওয়াইয়ের শহর কনায় জড়ো হয়েছে নিজেকে 'লৌহমানব' হিসেবে প্রমাণ করার জন্য। আর সেই পথটা মোটেই সহজ নয়। তিন ধাপে পাহাড়সম সব চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
প্রথম ধাপে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে খোলা সাগরে। একটু অমনোযোগী হলেই মুখে ঢুকে পড়বে সমুদ্রের নোনা পানি। সাথে প্রতিবারের স্ট্রোককে আরও কঠিন করে তোলার জন্য নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কা তো রয়েছেই। উন্মুক্ত সাগরে ৩.৯ কিলোমিটারের এই সাঁতারের প্রতিটা মুহূর্তে মনে হবে, "কখন শেষ হবে এই যাত্রা?" আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জের প্রথম এই অংশই এতটা কঠিন হয়ে পড়ে যে অনেকেই এই অংশ থেকেই ফিরে আসেন। তাছাড়া পানিতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাকে উদ্ধার করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে কেবল ২০২৩ সালেই মারা গিয়েছেন ১৩ জন, যার ১০ জনের দেহ পানি থেকে নিঃসাড় অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

সাঁতার শেষ হওয়ার পর সাঁতারুরা পরিণত হবেন সাইক্লিস্টে। উঁচু-নিচু ১৮০ কিলোমিটারের পাহাড়ি পথ শরীরের সর্বোচ্চটুকু শুষে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। শরীরের পেশিগুলোর চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া এই ট্র্যাকে প্রয়োজন সাইক্লিং দক্ষতা আর মনোযোগ। কারণ সামান্য অন্যমনস্কতাও ডেকে নিয়ে আসতে পারে দুর্ঘটনা। আর পাহাড়ি পথে দুর্ঘটনার ফলাফল হতে পারে মারাত্মক। প্রচণ্ড গতিতে সাইক্লিং করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাথায় বা শরীরের অন্যান্য অংশে আঘাত পেয়ে মারা যাওয়া প্রতিযোগীর সংখ্যা একেবারে কম নয়।
প্রতিযোগিতার শেষ ধাপ ৪২.২ কিলোমিটারের ম্যারাথন দৌড়। সাঁতার আর সাইক্লিংয়ের পর ভেঙে পড়তে চাওয়া শরীর নিয়ে তখন ছুটে চলা সম্ভব কেবল অদম্য মনোবলের জোরেই। মাসল ক্র্যাম্প, ক্ষুধা আর পানিশূণ্যতার ভয় তাড়া করতে থাকে সবসময়। প্রতিটা পদক্ষেপ তখন প্রমাণ দেয় মানবশরীরের সক্ষমতা আর সহ্যক্ষমতার। অনেক প্রতিযোগীই এই সময় ধকল সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যান। পানিশূণ্যতা বা অন্য কারণে এ পর্যায়ে মারা যাওয়ার উদাহরণও রয়েছে বেশ কিছু। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসেই ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়া হাফ আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় দৌড়ানোর সময়েই একাধিক অঙ্গ নিশ্চল হয়ে মারা যান ভারতের কামাখ্যা সিদ্ধার্থ।
আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জ এত কঠিন হওয়ার আরেকটি কারণ এটি শেষ করতে একজন প্রতিযোগী মোট সময় পান সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা। এর মধ্যে প্রথম দুই ঘণ্টা ২০ মিনিটের মধ্যে সাঁতার শেষ করতে হয়। সাইক্লিংয়ের ক্ষেত্রে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রথম দশ থেকে সাড়ে দশ ঘণ্টায়। শেষ অংশটুকু বরাদ্দ থাকে ম্যারাথনের জন্য। এখনো পর্যন্ত পুরো আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জ শেষ করার রেকর্ড নরওয়েজীয় ট্রায়াথলেট ক্রিস্টিয়ান ব্লুমেনফেল্টের দখলে। ২০২১ সালে মেক্সিকোর কজুমেলে হওয়া আয়রনম্যান শেষ করতে তিনি সময় নিয়েছিলেন মাত্র ৭ ঘণ্টা ২১ মিনিট ১২ সেকেন্ড।

আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জের শুরুটা হয়েছিল মূলত এক বিতর্ককে কেন্দ্র করে। দৌড়বিদ নাকি সাঁতারু, কারা বেশি ফিট এই নিয়ে শুরু হয়েছিল দুই দলের দ্বন্দ্ব। এদিকে এক স্পোর্টস ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে উঠে আসে এডুয়ার্ড জোসেফ নামের এক বেলজিয়ান সাইক্লিস্ট সর্বোচ্চ অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারেন। ফলে বিতর্কে যোগ হয় সাইক্লিস্টদের নামও। এই তিন ইভেন্টের মিশ্রণে তৈরি হওয়া ট্রায়াথলন আগেও খেলা হয়েছিল, তবে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। এমনকি কোনো কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদও (গভর্নিং বডি) গঠিত হয়নি তখনো পর্যন্ত।
এরকমই এক অবস্থায় ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে তিন ইভেন্টের সমন্বয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। স্থানীয় ১৫ জন অ্যাথলেটের প্রত্যেকের কাছে প্রতিযোগিতার নিয়ম আর গন্তব্য লেখা তিনটি কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়, যার শেষ পৃষ্ঠায় লেখা: "২.৪ মাইল সাঁতার কাটো! ১১২ মাইল সাইকেল চালাও! ২৬.২ মাইল দৌড়াও! আর সারাজীবন এটা নিয়ে গর্ব করো।" প্রতিযোগিতার আগেই বলে দেওয়া হয়, যে এই চ্যালেঞ্জ শেষ করতে পারবে, তাকেই দেওয়া হবে 'আয়রনম্যান' খেতাব ।
কয়েক বছরের মধ্যেই আয়রনম্যান স্থানীয়দের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশ থেকে অ্যাথলেটরা এতে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। অবশেষে ১৯৮২ সাল থেকে হাওয়াইয়ের কাইলুয়া-কনায় প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে আয়রনম্যান চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করা হতে থাকে। ট্রায়াথলেটদের আগ্রহ এতটাই বেড়ে যায় যে শেষমেশ লটারির মাধ্যমে ১০০০ জনকে বাছাই করে হাওয়াইয়ে ডাকা হতে থাকে।
১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আয়রনম্যান ইভেন্টকে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নিয়মে কোনো পরিবর্তন না এনেই এগুলো অনুষ্ঠিত হতে থাকে অন্যান্য দেশগুলোতে। একদিকে যেমন আয়রনম্যানের তালিকায় ট্রায়াথলেটদের নামের পরিমাণ বাড়তে থাকে, অন্যদিকে এগুলোকে ব্যবহার করা হতে থাকে হাওয়াইয়ের কনায় আয়রনম্যান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাই পর্ব হিসেবে।

অ্যামেচার ট্রায়াথলেটরা বয়স আর প্রতিযোগিতা শেষ করার সময়ের ভিত্তিতে প্রতিযোগীরা মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান। অন্যদিকে, পেশাদার ট্রায়াথলেটরা জায়গা পান প্রতিযোগিতা থেকে পাওয়া পয়েন্টের র্যাংকিং অনুসারে। বর্তমানে ২৫টিরও বেশি দেশে প্রতিবছর ৫০-টির বেশি আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশের লৌহমানবেরা
২০১৯ সাল পর্যন্তও স্বাস্থ্য নিয়ে উদাসীন ছিলেন জনতা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার আরিফুর রহমান। তারপর সিদ্ধান্ত নেন এ বিষয়ে আরেকটু সচেতন হবেন। শুরু করেন দৌড়াদৌড়ি। ২০২০ সালে করোনা মহামারীর পুরোটা সময় কাজে লাগান। সে সময়েই জানতে পারেন আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জের কথা। পরিকল্পনা করেন নিজের শরীরের সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে পরীক্ষা করে দেখবেন। মনে মনেই দৃঢ় সংকল্প করে ফেলেন লৌহমানবের খাতায় নিজের নাম লেখাবেন।
সে উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু হয় প্রশিক্ষণ। তিনটি ইভেন্টের প্রতিটির জন্য সপ্তাহে দুইদিন বরাদ্দ রাখেন। প্রতিদিন অন্তত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা ব্যয় করতে থাকেন সাঁতার, দৌড় কিংবা সাইক্লিংয়ে। আরিফ জানান, "আয়রনম্যানের প্রস্তুতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। যারা আগে থেকেই এনডিউর্যান্স স্পোর্টসের কোনো একটার সাথে জড়িত, তারা ইতিমধ্যেই বেশ খানিকটা ফিট। ফলে তাদেরকে কেবল নিজেদের প্রশিক্ষণের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়াতে হয়। কিন্তু যারা একেবারেই নতুন, তাদের কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছর নিয়মিত প্রশিক্ষণের ওপর থাকা জরুরি। শুরুতে আমাকেও সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে।"

একই অভিমত ইমতিয়াজ ইলাহীরও। তার মতে, এনডিউর্যান্স স্পোর্টসগুলোর যেকোনো একটির সাথে জড়িত ব্যক্তি ছয় থেকে আট মাসের মধ্যেই আয়রনম্যানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন। দৌড়, সাঁতার বা সাইক্লিংয়ের যেটিতে তিনি কম সময় ব্যয় করেছেন, প্রয়োজন ও লক্ষ্য অনুযায়ী তাকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৬ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্তও প্রশিক্ষণ নিতে পারেন কেউ কেউ, যার পুরোটাই নির্ভর করছে তার শরীরের সক্ষমতা এবং লক্ষ্যের ওপর।
অনেকেই নিজের শরীরের সামর্থ্য কতটুকু তা বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে আয়রনম্যানে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে মাঝপথে অনেকেই হাল ছেড়ে দেন। এমনকি মারাও যান কেউ কেউ। আয়রনম্যানের মতো ট্রায়াথলন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে মৃত্যুর তালিকা বিশাল, অন্তত অন্য খেলাগুলোর তুলনায়। এ প্রসঙ্গে ইমতিয়াজ জানান, "এবারের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপেই বাংলাদেশের একজন প্রতিযোগী সাঁতারের পর সাইক্লিং করার সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান এবং মারাত্মকভাবে আহত হন। তাকে খুব দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বেশ কিছু জায়গায় সেলাইয়ের প্রয়োজন পড়ে। আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যেহেতু বড় পরিমাণ খরচ করতে হয়, তাই এর আগে নিজের শারীরিক সামর্থ্য যাচাই করা জরুরি।"
আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় দুর্ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরিফ জানান, "সরাসরি দুর্ঘটনা দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি। তবে এ বছরেই মালয়েশিয়াতে একজন প্রতিযোগী সাঁতারের সময় মারা গিয়েছিলেন। এছাড়াও মালয়েশিয়া থেকে ফেরার সময় বিমানবন্দরে একজন জাপানি প্রতিযোগীর সাথে দেখা হয় স্লিংয়ে হাত বাঁধা অবস্থায়। সাইক্লিংয়ের সময় তিনি পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে ফেলেছিলেন।"

কেবল প্রশিক্ষণ আর প্রস্তুতির ওপরেই সবকিছু নির্ভর করে এমন নয়। অনেক সময় ঐ দিনের আবহাওয়া প্রতিযোগীদেরকে আরও প্রতিকূল অবস্থায় ফেলে দেয়। আরিফুর রহমান এ প্রসঙ্গে তার ২০২২ সালের আয়রনম্যান মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেন: "ঠিক ইভেন্টের দিনই সারাদিন ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টি ও বাতাস। সাইক্লিংয়ের সময় আমরা সবাই পাহাড়ি ঢলের সামনে পড়ি। সাইক্লিংয়ের অনেকটা পথ আমাদেরকে হেঁটে এগোতে হয়। এমনিতেই পাহাড়ি রাস্তা, তার উপর বাড়তি এই ধকল আমাদের শরীরের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। রেস শেষ করার পর প্রতিযোগীদের প্রায় সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কারো প্রচণ্ড জ্বর, কারো লো প্রেশার।"
বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত মোট ১৫ জন আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জ শেষ করেছেন। তাদের মধ্যে ১০ জন আঞ্চলিক আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা শেষ করেছেন। বাকি ৫ জন এগুলোর পাশাপাশি সুযোগ পেয়েছেন মূল আয়রনম্যান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করার। এর মধ্যে ২০২১ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম আয়রনম্যান মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত। যদিও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সে বছর হাওয়াইয়ের বদলে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল ইউটায়। ২০২৩ সালেও প্রথমবারের মতো আয়রনম্যান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয় ফ্রান্সের উপকূলীয় শহর নিসে। আরাফাতের সাথে এবার যোগ দেন আরও ৪ জন: আরিফুর রহমান, মিশু বিশ্বাস, শুভ দে এবং পবিত্র কুমার দাস।

বাংলাদেশি ট্রায়াথলেটদের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়েই প্রতিনিয়ত লড়ে যেতে হয়। প্রথমত, প্রশিক্ষণের জন্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব। ঢাকায় দৌড়ানোর জন্য পার্ক থাকলেও সুইমিং পুল বা সাইকেল ট্র্যাকের অপর্যাপ্ততা প্রচণ্ড। বিশেষ করে সাইক্লিং করার জায়গা নেই বললেই চলে বলে জানান আরিফ। তার মতে, বিদেশের রাস্তায় সাইক্লিং করার আলাদা লেন থাকলেও বাংলাদেশে এ সুবিধার কথা চিন্তা করাই বেমানান। মাওয়া হাইওয়ে সাইক্লিং করার মতো উপযুক্ত হলেও এ রাস্তায় সাধারণত সাইকেল চালাতে দেওয়া হয় না বিপদের কথা চিন্তা করে। এছাড়াও নোনা পানির উন্মুক্ত সমুদ্র কেবল কক্সবাজার বা বাংলা চ্যানেলেই পাওয়া যায়।
এদিকে বাংলাদেশি ট্রায়াথলেটদের জন্য পাহাড়ি রাস্তায় সাইক্লিংয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে। কিন্তু আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জের সাইক্লিং ট্র্যাকের অনেকখানিই এ ধরনের রাস্তা। এ কারণে আপহিল বা ডাউনহিল রাস্তায় সাইক্লিং করতে বেশ ঝক্কি পোহাতে বলে জানান আরিফ: "অভিজ্ঞ আয়রনম্যানরাও বলেন এ ধরনের রাস্তায় সাইকেল চালাতে হলে কয়েক বছরের সাইক্লিংয়ের অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। দুর্ঘটনাও ঘটে এ পর্যায়ে। দেখা যায়, তাল সামলাতে না পেরে অনেকেই রাস্তায় পড়ে গিয়ে আহত হন। ফলে তাকে আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জ শেষ না করেই ফিরে আসতে হয়।"
দ্বিতীয়ত, আর্থিক সমস্যা। ট্রায়াথলনে অংশগ্রহণের জন্য বেশ কিছু দামি দামি ইকুইপমেন্ট প্রয়োজন হয়, যেগুলো স্পন্সর ছাড়া বাংলাদেশি অ্যাথলেটদের কাছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আরিফের মতে, বিদেশি অ্যাথলেটরা যে ধরনের সাইকেল ব্যবহার করেন, তা বাংলাদেশে আনতে হলে ৮ থেকে ২০ লক্ষ টাকা খরচ হতে পারে। এদিকে ইমতিয়াজ জানান, "সাঁতারের জন্য ওয়েটস্যুট, দৌড়ের জন্য রানিং শ্যুসহ অন্যান্য ইকুইপমেন্টেরও খরচ প্রচুর।"
ইকুইপমেন্ট ছাড়াও লজিস্টিক খাতে রয়েছে আরও খরচ । প্রতিযোগিতার রেজিস্ট্রেশন, যাওয়া-আসার বিমান ভাড়া কিংবা থাকা-খাওয়ার খরচ সবার পক্ষে বহন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশি অ্যাথলেটদের আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় কম অংশগ্রহণের আরেকটি বড় কারণ হিসেবে এটিকে উল্লেখ করেন ইমতিয়াজ।

ট্রায়াথলেটদের ফিটনেস ধরে রাখার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো খাবার। পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি নিজেদের ওজনের দিকেও নজর রাখতে হয় আয়রনম্যানদেরকে। আর এজন্য খাবারের পেছনেও কিছুটা অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হয়। দূরে থাকতে হয় ফাস্টফুডসহ শরীরের জন্য ক্ষতিকর খাবার থেকে।
তবে এর সবকিছুর বাইরে আয়রনম্যান হওয়ার জন্য প্রয়োজন কঠোর শৃঙ্খলা। নিয়মিত সময় অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম, কাজ এবং প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে হয়। এ সময় পরিবারের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা দারুণভাবে কাজ করে বলে মনে করেন ইমতিয়াজ। কারণ প্রশিক্ষণের জন্য বেশ ভালো পরিমাণ সময়, শ্রম ও অর্থ ঢালতে হয়। এছাড়াও অ্যাথলেটদের কমিউনিটির সাথে যুক্ত হয়ে একসাথে ট্রেনিং বা এক্সারসাইজ করাও নিজের উদ্যম ও প্রেরণা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
ট্রায়াথলেটে আগ্রহী নতুনদের জন্য দুজনেরই পরামর্শ হঠাৎ করে প্রচণ্ড চাপ না নিয়ে সময় নিয়ে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ শুরু করা। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে সময় বাছাই করে নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ধীরে ধীরে প্রশিক্ষণের সময় বাড়াতে বলেছেন তারা। একইসাথে অন্যান্য অ্যাথলেটিক্স ইভেন্টে অংশগ্রহণও নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। এজন্য ম্যারাথন, আল্ট্রা-ম্যারাথন, সাইক্লিং, আল্ট্রা-ট্রায়াথলন বা মাউন্টেইনিয়ারিংয়ে অংশগ্রহণ করা থেকে শুরু করে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া পর্যন্ত অনেক কিছুই করা যেতে পারে। আর এগুলো পেরিয়েই আয়রনম্যানে অংশগ্রহণের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তর করেছেন তারা।
তবে আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জে শারীরিক সামর্থ্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মানসিক শক্তি। আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জের প্রতি মুহূর্তে এই মনের জোরই প্রতিযোগীকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগায়। বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হয়, "এই চ্যালেঞ্জ অসম্ভব কিছু নয়।" আর এ কারণেই ২০১৪ সালের আয়রনম্যান চ্যাম্পিয়ন সেবাস্তিয়ান কিনলে বলেছিলেন, "Your body drives you to the finish line, but your mind makes you cross it."