মণিপুরী শাড়ির সঙ্গে ‘কৈফিয়া’র পথচলা!

'মণিপুরী শাড়িও হতে পারে বিয়ের শাড়ি!'- ফেসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে হঠাৎ এরকম এক লেখা দেখে চোখ আটকে গেল। রক্ত লাল জমিন আর জরির পাড়, জমিনে সুন্দর নকশা তোলা এক শাড়ি। নিঃসন্দেহে লাল টুকটুকে বউয়ের কথা ভেবেই এ শাড়ি বানানো। 'কৈফিয়া তাঁতঘর' নামে ফেসবুক পেজটিতে পিন করা এ পোস্ট দেখে বেশ আগ্রহ নিয়েই স্বত্বাধিকারী রওশান আরা দীপ্তির সঙ্গে আলাপ শুরু করি। তখন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের এক মণিপুরী গ্রামেই ছিলেন দীপ্তি। জানলাম, সবশেষ কয়েক বছর ধরে কখনও ঢাকা, কখনও মণিপুরীদের গ্রামে থেকেই চলছে দীপ্তির 'কৈফিয়া'-র কাজ; যার শুরুটা হয়েছিল ২০১৯ সালে।
"ওইবছরই প্রথম বেড়াতে আসি মণিপুরী পাড়ায়। নিতান্ত অজপাড়াগাঁ বললেও ভুল হবে না। এখানে আসার পর ভালো লেগে যায় মণিপুরীদের তাঁত শিল্প। তখনও জানতাম না যে এই মণিপুরীদের তাঁতই হয়ে উঠবে আমার সবকিছু," বলছিলেন দীপ্তি।
একে একে জানালেন মণিপুরী পণ্য আর কৈফিয়ার গল্প। দীপ্তির জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই ফরিদপুরে। ফরিদপুরের মেয়ে হয়ে সিলেটের মণিপুরী পণ্য নিয়ে ব্যবসা! কিভাবে হলো? "তাঁতের প্রতি ভালোবাসা তো আগেই ছিল। ছোটবেলা থেকেই বিবি রাসেলকে দেখতাম। খুব ভালো লাগতো ওনাকে। ওনার প্রতি ভালোলাগা থাকার কারণেই তাঁতের প্রতি একটা ভালোবাসা তৈরি হয়। ফলে নিজের আগ্রহ থেকে মণিপুরী তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলি," জানালেন তিনি।

"পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছিল, তাদের উত্তরসূরীরাই এখন এ কাজে আসতে চান না। কারণ, এ শিল্পে প্রাপ্য মজুরি পান না তারা। সেসময় তাদের প্রতি অনেকটা দায়বদ্ধতা থেকেই পণ্যগুলো বিক্রি করতে চাই।
"ওইসময় তাদের কাছে জানতে চাই, মজুরি ঠিকমতো মিললে এই কাজ করবেন কিনা, ওদের পণ্যগুলো যদি আমি এনে বিক্রি করে দেই তাহলে তারা আবার কাপড় বুনবেন কিনা। তবে কাজটা যাতে ওরা ছেড়ে না দেয়, তাই ওদের সঙ্গে কোনো দর কষাকষিতে যাবো না এটাও বলে দেই। এই চুক্তিতে রাজি হন তারা। পরে তাদের কাছ থেকে বেশ কয়েকটা শাড়ি নিয়ে আসি। ওইসময় আমি একটা কল সেন্টারে কাজ করতাম। অফিসে প্রচুর কাস্টোমার ছিল। ফলে সব শাড়ি বিক্রি করে ফেলতাম অফিসেই," কৈফিয়ার শুরুর গল্প বলছিলেন দীপ্তি।
আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি দীপ্তিকে। তবে এই ফেসবুক পেজ খোলা হয় কাজ শুরুর প্রায় মাস ছয়েক পরে। এরপরই ছেড়ে দেন কল সেন্টারের চাকরি। তবে এরও একটা গল্প রয়েছে। তার ব্যবসা যখন বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়েছে, সেইসময় স্বয়ং তার অফিসের বস তাকে ব্যবসায় মনোযোগ বাড়াতে বলেন। অনেকটা সেই কথায় অনুপ্রাণিত হয়েই এবারে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা দীপ্তির।
বলছিলেন, "পরে এক বান্ধবীর কথা শুনে নারী উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপে যোগ দেই। কিন্তু তখন নিজের কোনো ফেসবুক পেজ ছিল না। শুধু দাম জানাবো আর ইনবক্সে আসতে বলব, এরকমটা করতে ভালো লাগতো না। এর কয়েকমাস পর অক্টোবরের দিকে একটা পেজ খুলে ফেলি।"

জানালেন, ফেসবুক পেজ নয়, নিজের ফেসবুক একাউন্ট থেকেও বিক্রি হয় প্রচুর শাড়ি। প্রায় শূন্য হাতে শুরু করে এখন প্রতিমাসে গড়ে আশি হাজার থেকে লাখ টাকার ওপরেও বিক্রি হয়। আড়াই হাজার থেকে শুরু করে ৫/৬ হাজারের ভেতর পাওয়া যায় শাড়িগুলো।
মণিপুরী শাড়ি সুতিরও হয় বলে জানালেন কৈফিয়ার স্বত্বাধিকারী। যদিও তার পরিমাণ খুবই কম। কারণ সুতায় বুনন করা শাড়িগুলো দামের দিক থেকে সবার সাধ্যের মধ্যে থাকে না। সুতার কাজগুলো অনেক বেশি নান্দনিক আর আরামদায়ক হয় বলেও জানালেন তিনি। এ শাড়িগুলোর দাম সাধারণত সাড়ে ৬ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়।
এ শাড়িগুলো যেমন পরতেও আরাম, তেমনি মানিয়ে যায় যেকোনো জায়গায়, আবার সহজে পরিষ্কারও করা হয়- সব মিলিয়েই মণিপুরী শাড়ির গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। আর সবচেয়ে বড় কথা এ শাড়িগুলো দামেও সস্তা। তাই কিছুক্ষেত্রে মণিপুরী শাড়ি ছাপিয়ে যাচ্ছে জামদানিকে, এমন দাবি দীপ্তির।
পেয়েছেন পারিবারিক সমর্থন, নতুন পরিবারও!
১০ ভাইবোনের ভেতর সবচেয়ে ছোট দীপ্তি। ছোট হওয়ায় অনেক বেশি আদর পাবেন তা তো বটেই, পেয়েছেন স্বাধীনতাও। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার নিজস্ব কর্মস্পৃহা। সবকিছুই তাকে উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে বেশ সাহায্য করছে বলে জানালেন। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে তার বাবার দেওয়া ছোট্ট একটা উপদেশ।

ছোট থাকতে নাকি তার বাবা বলেছিলেন, কারও কোনো কথা পছন্দ না হলে সেটিতে কর্ণপাত না করতে। তাই এখন ব্যবসা করতে গিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য কানে নেন না দীপ্তি।
"তবে পরিবারের কাছ থেকে কখনও অসহযোগিতা পাইনি। ব্যবসা শুরুর পর নিজের মতো করেই গুছিয়ে নিয়েছি।"
ব্যবসা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সাতবার মণিপুরী পাড়ায় গিয়ে থেকেছেন বলেও শুনলাম তার কাছ থেকে। "মণিপুরী শাড়ি বা পণ্য নিয়ে ব্যবসায় আসাটা ছিল মণিপুরীদের প্রতি ভালো লাগার জায়গা থেকে, তাদের সম্পর্কে কিছু জানার ইচ্ছে থেকে। এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা, খাওয়াদাওয়া বেশ সহজ-সরল। খুব সহজেই আপন করে নেওয়ার একটা অসাধারণ গুণ আছে।"
মণিপুরী পাড়ায় যারা ঘুরতে যাবেন তাদের থাকার জন্য অসাধারণ এক ব্যবস্থা বলেও জানালেন তিনি। হোমস্টে সার্ভিসের ক্ষেত্রে থাকা-খাওয়া দুটোরই ব্যবস্থা করেন মণিপুরীরাই। পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে খাবারের ব্যবস্থা করেন তারা। মুসলিমদের হালাল-হারামও বেশ ভালোই মানা হয় বলে শুনছিলাম দীপ্তির কাছ থেকে। "তরতাজা সবজি আর হরেক মাছ থাকে প্রত্যেকদিনের মেন্যুতেই। ফলে খাবার নিয়ে বিড়ম্বনার কোনো সুযোগ নেই।"

এতোদিন ধরে ব্যবসায়িক কারণে যাওয়া-আসা করতে গিয়ে এতোটা পরিচিতি পেয়ে গেছেন যে, এখন আর হোমস্টে সার্ভিস নয়, এক মণিপুরী পরিবারেই থাকেন। সারাদিন ব্যবসার কাজ, আর কাজের ফাঁকে তরতাজা শাকসবজি আর মাছের তৈরি হরেকরকম পদ দিয়ে তিনবেলা ভোজন, মণিপুরীদেরই হাতের রান্নায় রীতিমতো মুগ্ধ দীপ্তি। গিয়েছেন মণিপুরী বিয়েতেও!
দীপ্তি জানালেন, মণিপুরী নারীদের পোশাকের এই তিন অংশ ফুরিত, ফানেক, ফিদুপ। তবে বিয়েতে যে ধরনের কাপড়গুলো তারা পরেন সেগুলো কিন্তু নিজেরা তৈরি করতে পারেন না, ভারতের মণিপুরী রাজ্য থেকে আনান এসব কাপড়।
কেন জিআই পণ্য হতে পারে সিলেটের মণিপুরী
ভারত ও বাংলাদেশে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রচুর লোক রয়েছে। বাংলাদেশেই প্রায় ৬০টি মণিপুরী গ্রাম রয়েছে। জিআই পণ্য হতে হলে কমপক্ষে ৫০ বছরের ঐতিহ্য থাকতে হয়, সেখানে প্রায় ৩০০ বছরের ঐতিহ্য রয়েছে বাংলাদেশি মণিপুরীদের, এ তথ্যও জানলাম তার কাছ থেকে।
বললেন, "ভারতে মণিপুরীদের জিআই ট্যাগ থাকা পণ্যের নাম 'মৈরাংফি'। এটি পিওর কটন এবং রেশমি সুতা দিয়ে তৈরি। অন্যদিকে আমাদের দেশের সিলেটি মণিপুরী শাড়ির সুতা আসে নরসিংদী থেকে। যা মূলত মিক্সড ধরনের সুতা। নামেও ভিন্নতা রয়েছে। ভারতে এর নাম 'মৈরাং', আমাদের দেশে 'মণিপুরী তাঁত'। নকশা, সুতা সবই আলাদা।" অতএব মণিপুরী জিআই হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে বলে জানালেন তিনি।
তবে একে জিআই পণ্য হিসেবে উপস্থাপনের জন্য আরও বেশি প্রচার দরকার বলে মনে করেন দীপ্তি। বিশেষ করে শাড়িগুলোর পেছনের গল্প তুলে ধরা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
"সবসময় চেষ্টা করি শাড়িগুলোর ভেতরের গল্প বলতে। শাড়ির কারিগরদের গল্পগুলো ক্রেতাদের জানাতে চাই। এতে এমনও হয়েছে যে শাড়ির ছবিও দেওয়া লাগেনি, শুধু বর্ণনা পড়ে এমনিতেই বিক্রি হয়ে গেছে!"
যদিও ব্যবসার ক্ষেত্রে সরাসরি মণিপুরীদের সঙ্গে মেশাটা অনেক বেশি কাজে লেগেছে বলেও জানালেন দীপ্তি।
"শাড়ি তো শাড়িই, এর আবার কী গল্প? এরকম মনে হলেও, একেকটা শাড়ি বুননের পেছনে হাজারও গল্প থাকে", বলতে বলতে শাড়ি তৈরির বিস্তারিত বর্ণনার কারণ হিসেবে জানালেন রাজিব আহমেদ নামে এক ব্যক্তির কথা। তার উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে আমূল পরিবর্তনের কারিগর তিনি, এমনটি জানালেন দীপ্তি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির অধীনে নিবন্ধিত সংস্থা 'ই-ক্যাব'-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন রাজিব আহমেদ।
"তার অনুপ্রেরণা এবং তাঁতের প্রতি আগ্রহের জায়গা থেকেই মূলত মণিপুরীদের সঙ্গে থেকে, তাদের সঙ্গে মিশে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছি। তার কথা শুনেই মানুষের কাছে ওদের গল্পগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করতাম। কিন্তু যখন কৈফিয়া'র ফেসবুক পেজ খুলি, সেসময় বাংলা টাইপ পারতাম না। এজন্য বাংলা টাইপিংও শিখেছি।"
মণিপুরী তাঁত কেন জিআই (ভৌগলিক নির্দেশক) পণ্য হতে পারে সে প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই আবারও জানালেন তার 'গুরু' রাজিব আহমেদের কথা। শুধু পণ্য কেনাবেচার স্বার্থে নয়, যেই ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করা হবে, তার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করা, তাদের জীবনধারা সম্পর্কে মানুষকে জানানো প্রয়োজন। কারণ, মানুষ যত জানবে, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা ততটাই বেড়ে যাবে, রাজিব আহমেদের কাছ থেকেই এমনটাই শিখেছেন বলে দাবি তার।
আরবিতে 'কৈফিয়া' শব্দের অর্থ সুখী বা আনন্দিত। নিজের কাজকে উপভোগ করতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকেই পেজের এমন নাম রাখেন দীপ্তি। মণিপুরীদের জীবনযাত্রা দেখতে গেলেও তাদের তৈরি একটি কাপড় কেনার অনুরোধ জানান দীপ্তি। এরমধ্য দিয়ে স্পষ্টই বোঝা যায় শুধু কাজ উপভোগই নয়, কাজের বিষয়ে এবং মণিপুরী তাঁতের পণ্যকে জিআই হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়েও কতটুকু আন্তরিক দীপ্তি।