মায়া যেভাবে তথ্যচিত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলা বাঘে পরিণত হলো

মাত্র ১৪ বছর বয়সে ঐশ্বরিয়া প্রথমবারের মতো মায়ার দেখা পায়। ভারতে ঐশ্বরিয়ার বাড়ি মহারাষ্ট্রের তাড়োবা আন্ধেরি ন্যাশনাল পার্কে থাকত মায়া। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার এবং ফিল্মমেকার ঐশ্বরিয়া শ্রীধর তখনো জানতো না যে এই মায়াবী শাবকই একদিন তাকে এনে দিবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
মায়া নিজেও তখন বেশ ছোট। কাঁদামাটিতে বাবা-মায়ের সাথে দাপাদাপিতে ব্যস্ত। কখনো মায়ের থাবায় গিয়ে খোঁটাচ্ছে, আবার কখনো বাবার লেজ ধরে টানছে।
সেই প্রথম দেখার আরও দুই বছর পর ঐশ্বরিয়া মায়াকে তার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তথ্যচিত্রের মুখ্য চরিত্র হিসেবে নির্বাচন করেছিল। সোমবার ওএসএন টেলিভিশিন চ্যানেলে স্থানীয়ভাবে প্রথমবারের মতো প্রচারিত হয় "টাইগার কুইন অব তরু"।
তবে ঐশ্বরিয়া তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, মায়ার মাঝে কিছু বিশেষত্ব আছে। "মায়াকে তার অন্য ভাইবোনদের থেকে সহজেই আলাদা করা যেত। সর্বত্র ছিল তার বিচরণ। পার্কে যেই আসত বুঝতে পারত যে মায়া রাজত্ব করার জন্যই বেড়ে উঠছে," বলেন ঐশ্বরিয়া।
তবে মায়ার মা লীলা যে এতো তাড়াতাড়ি মারা যাবে, সেটা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। ধারণা করা হয় সাপের দংশনে মারা যায় এই মা বাঘ। মায়াসহ সবগুলো শাবক ছোট থাকতেই মাতৃহারা হয়ে পড়ে।
"মায়ার ছোটবেলার দিনগুলো বেশ কঠিন ছিল। তবে সময়ের সাথে সে তার মায়ের সিংহাসন দখল করেছিল, সেই সাথে পার্কের অভয়ারণ্যে নিজের রাজত্ব আর বিচরণ ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত করেছিল।"
তবে মায়ার সামনে আরও খারাপ অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল। একদিন শিকার থেকে ফিরে মায়া দেখে তার তিনটি শাবকই নিখোঁজ। কমবয়সী এক পুরুষ বাঘ এসে তার জায়গা দখল করেছে।
তবে প্রচণ্ড আঘাতেও ভেঙে পড়েনি মায়া। নিজের জায়গা ছেড়ে বহু দূরে অভয়ারণ্যের প্রায় শেষ সীমায় গিয়ে নিজের এক পুরোনো সঙ্গীকে নিয়ে ফিরে আসে। অনাহূত এই নতুন বাঘকে নিজের জায়গা থেকে তাড়াতেই পুরোনো সাথীর সঙ্গ নেওয়া।
পুরো বিষয়টাই নিরাপদ অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করছিল শ্রীধর। তিনি বলেন, "মায়া যখন তার নিজের রাজত্ব পুনর্দখলের জন্য ফিরে আসে তখনই আমি বুঝেছিলাম ও সাধারণ কেউ নয়। আমরা ভেবেছিলাম ওর শাবকগুলোও আর বেঁচে নেই। কিন্তু তিনি মাস পর মায়া আবার তাদের খুঁজে পায়।"
শ্রীধর তখনই মায়াকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। মায়ার গল্প হার না মানার, ভালোবাসার, রক্তাক্ত প্রতিশোধ আর বিশ্বাসভঙ্গের। শ্রীধর মায়ার জীবন কাহিনীকে বলিউড সিনেমার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, সে জন্যই হয়তো মায়া ভারতের সবথেকে বিখ্যাত বাঘ।
গুগলে একটু খুঁজতেই বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেল। অজস্র ব্লগপোস্ট, ছবি আর ভিডিওতে মায়ার হরিণ শিকার, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে লড়াই আর সাফারি জিপের মাঝে শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য দেখা গেল। মায়া যে তহ্যচিত্রে বিশ্বের সর্বাধিক দেখা বাঘদের একজন তা স্বীকার না করে উপায় নেই।

তবে ইন্টারনেট ঘেটে পাওয়া তথ্যগুলোতে 'টাইগার কুইন অব তরু'র মতো দুঃসাহসিক অভিযানের রোমাঞ্চ মিলবে না।
২০১৪ সাল থেকে শ্রীধর এই প্রজেক্ট শুরু করেন। বাঘের চিত্র ধারণ করতে স্কুলবইয়ের সাথে ক্যামেরা নিয়ে তিনি রিজার্ভে ছুটতেন। শ্রীধর জানান, স্কুলের পাশাপাশি শুটিং করা কঠিন হলেও তিনি হার মানেননি। বন্ধুরাও তাকে সহযোগিতা করতো।
"আমি নিয়মিতভাবে মাঠে কাজ করতে যেতে পারতাম না। বিশেষ করে যখন বোর্ড পরীক্ষা চলত, আমার অনেক বন্ধুরাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল," বলেন শ্রীধর।
শ্রীধরের চিত্র ধারণ শেষ হলে, ফুটেজগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার প্রোডাকশন হাউজ প্রতিষ্ঠান 'আর্থ-টাচ'- এর নজরে আসে। আরও কিছুদিন প্রজেক্ট ডেভলপের পর তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির হাতে তার তৈরি তথ্যচিত্র দিতে সক্ষম হন।
মায়ার উপর নির্ভর করে পুরো তথ্যচিত্র বানানো হলেও শ্রীধর আশা করেন যে, ফিল্মটি বাঘদের নিয়ে নতুন করে মানুষের আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করবে।
"অধিকাংশ মানুষ ভাবে বাঘ কেবল মাংশাসী এক প্রাণী। তাদের আবেগ-অনুভূতি বা বিবেচনা বোধ নেই," বলেন শ্রীধর। "মানুষ ভাবে বাঘ প্রকৃতিতে হিংস্র আর ইন্দ্রীয় নির্ভর। কিন্তু মধ্য ভারতে তাদের সাথে সময় কাটানোর পর আমার এমন মনে হয়নি। মায়ার মতো বেশিরভাগ বাঘই ঠিক মানুষের মতোই পরিকল্পনা করতে পারে।"
মায়ার গল্প পৃথিবীর মানুষ জানতে পারবে ভেবে ঐশ্বরিয়া বেশ রোমাঞ্চিত। তার বিশ্বাস দর্শকরাও তার মতো করে এই টাইগার কুইনকে চিনতে পারবেন।
মায়ার কাছে কী শিখলেন সে সম্পর্কে শ্রীধর বলেন, "জীবনে যতো ব্যর্থতাই আসুক না কেন, আপনাকে লেগে থাকতে হবে।"
"এখানে অনেক বাঘ আছে যাদের নজর মায়ার রাজত্বের উপর। এতো বিশাল জায়গা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ কাজ নয়," যোগ করেন তিনি।
তথ্যচিত্র তৈরিতে মায়ার পেছনে শ্রীধর বেশ কয়েক বছর সময় দিয়েছেন। তবে একই সময় তিনি অন্যান্য প্রজেক্টেও কাজ করেছেন।
২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় শ্রীধরের 'পাঞ্জে: দ্য লাস্ট ওয়েটল্যান্ড'। ভারতের রাষ্ট্রীয় চ্যানেল ডিডি ন্যাশনালে তথ্যচিত্রটি প্রচারিত হয়।
"ওই সময় আমাদের বাড়ির আশেপাশে বহু জলাভূমি ধ্বংস হতে দেখছিলাম। আমি চেয়েছিলাম এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে," বলেন তিনি।
"সেটাই আমার প্রথম পরিপূর্ণ প্রজেক্ট ছিল। কীভাবে এডিট করতে হয়, পাশাপাশি সাউন্ড এবং প্রেজেন্টেশনের কাজগুলোও ওই ডকুমেন্ট বানাতে গিয়েই শেখা," যোগ করেন শ্রীধর।
'পাঞ্জে: দ্য লাস্ট ওয়েটল্যান্ড" শেষ পর্যন্ত বোম্বে হাইকোর্টের নজরে আসে। হাইকোর্টের নির্দেশনায় জলাভূমি দখলের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
শ্রীধর জানান, তিনি সবসময় আরণ্যক নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। এর জন্য বিশেষ ভাবে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সদস্য বাবাকে ধন্যবাদ জানান শ্রীধর।
"আমার এগারো তম জন্মদিনে বাবা আমাকে একটা পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরা উপহার দেন। এরপর থেকেই আমি আরণ্যকের জীবন আরও বেশি করে ক্যামেরায় ধারণ করতে চাইতাম। দিন দিন আমার ক্যামেরার আকারও বাড়তে থাকে। আমার ক্যামেরাও আমার সাথে লম্বা হচ্ছে বলে বন্ধুরা ঠাট্টা করত," স্মৃতিচারণ করে বলেন শ্রীধর।
তিনি জানান, সামনে তার আরও অনেকগুলো প্রজেক্ট আছে। বিশেষ করে ভারতের প্রাইমেটদের (মানুষ, বানর, গরিলা জাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী) নিয়ে ধারাবাহিক তথ্যচিত্র বানাতে এখন তিনি ব্যস্ত।
"প্রাইমেটদের জীবনধারণের সংগ্রাম তুলে ধরতে চাই। কিছু প্রাণীতো প্রায় বিলুপ্তির পথে। জঙ্গলেও এখন তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই প্রাণীগুলোকে সংরক্ষণ করা কতোটা জরুরি আমি মানুষকে সেটাই জানাতে চাই,।" বলেন ঐশ্বরিয়া শ্রীধর।
- দ্য ন্যাশনাল থেকে অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা