পুরনো ভিডিও গেমসের দাম কেন কোটি টাকা?

এক যুগেরও বেশি সময় আগে রবার্তো ডিলনের যখন রেট্রো ভিডিও গেমস সংগ্রহ করার শখ জাগে, তখন তিনি নিলামকারী সাইটগুলো থেকে শুরু করে নানা ধরনের শখের বস্তু সংগ্রহ করে- এমনসব গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে ঢুঁ মেরেছেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই- ব্যক্তিগত সংগ্রহের পাল্লা ভারি করা।
এই মুহূর্তে ডিলনের কাছে থাকা পুরনো ভিডিও গেমসের সংখ্যা কয়েক শত। অথচ একসময় অধিকাংশ সংগ্রাহক মনে করতেন, ভিডিও গেমস সংগ্রহ করাটা আসলে এক রকমের ক্ষ্যাপাটে কাজ। শিক্ষাবিদ ও গেম ডেভলপার রবার্তো ডিলন নিজেই এই তথ্য জানান।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'বেশিরভাগ সংগ্রাহকই নিজের শৈশবের গেমস নিয়ে স্রেফ নস্টালজিক ছিলেন। কিন্তু তাদের কোনো ধারণা ছিল না, ভিডিও গেমসও এক প্রকার নিদর্শন হতে পারে এবং এগুলো আমরা সংরক্ষণ করতে চাই।'
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই ধারণা বদলে যায়। এ মাসের শুরুতেই ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া 'সুপার মারিও ব্রোস' নামক ভিডিও গেমসের একটি কপি রেকর্ড ২ মিলিয়ন ডলার [প্রায় ১৭ কোটি টাকা] মূল্যে নিলামে বিক্রি হয়। বিভিন্ন বস্তু ও নিদর্শন সংগ্রাহক ওয়েবসাইট 'র্যালি' এই নিলামের আয়োজন করে।
নিনটেন্ডো এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেমের (এনইএস) জন্য বানানো এই গেমস ছিল তৃতীয় ভিন্টেজ টাইটেল, যা এক মাসের মধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে দামি ভিডিও গেমস হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও সবচেয়ে দামি গেমসের খেতাবটা ছিল ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত 'সুপার মারিও ৬৪'-এর নামে। এটি বিক্রি হয়েছিল ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারে।
এই মুহূর্তে বহু বছর পুরনো ভিডিও গেমসের বাজার দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। নিলাম প্রতিষ্ঠানগুলো এখন 'ওয়াটা গেমসে'র মতো বিভিন্ন গেম-গ্রেডিং সেবা নিচ্ছে। ফলে উদীয়মান বাজারের গেমসগুলোকে সার্টিফিকেট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে এখন।
ব্যাপারটা আরও সহজ করে বললে দাঁড়ায়, গেম-গ্রেডিং সেবার মাধ্যমে বিক্রিত গেমসের মান নির্ধারণ করা হয় বা রেটিং দেওয়া হয়। রেকর্ড দামে বিক্রিত সুপার মারিওকে ওয়াটা গেমস দশে ৯ দশমিক ৮ রেটিং দিয়েছে। এভাবে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে মূল্যায়নের ফলে 'পোকেমনে'র একটি কপি এখন হাজার হাজার ডলারের বিনিয়োগে পরিণত হতে পারে।

সাংস্কৃতিক নিদর্শন
ডিলনের ভিডিও গেমস সংগ্রহ করাটাকে যদি আপনি স্রেফ শখ হিসেবে ধরে নেন, তাহলে ভুল করবেন। কারণ এটা তার চাকরির অংশও বটে! সিঙ্গাপুরের জেমস কুক ইউনিভার্সিটি মিউজিয়াম অব ভিডিও অ্যান্ড কম্পিউটার গেমসের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ তিনি। আর এই জাদুঘরে বর্তমানে গেমসের ৪০০ দুর্দান্ত সংগ্রহ আছে।
ডিলনের মতে, রেট্রো ভিডিও গেমস এখন এক ধরনের আধুনিক স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। সেইসঙ্গে নস্টালজিয়া, পপ সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিগত ইতিহাসও এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
তিনি বলেন, 'এটা আমাদেরকে দেখায় যে কীভাবে প্রযুক্তির বিবর্তন ঘটে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পছন্দ ও রুচি বদলে যাওয়ায় গেমিংয়ের ধরনেরও পরিবর্তন আসে।'
তবে পুরনো নিনটেন্ডো বা সেগা টাইটেলের গেমস হাতে নিয়ে বসে থাকা সকলেই যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করে, তা কিন্তু নয়। পুরনো ভিডিও গেমসের মূল্য নির্ধারণের পেছনে অনেক বিষয় কাজ করে। গেমসটির কত ইউনিট উৎপাদিত হয়েছিল, কোন অঞ্চলে এটি মুক্তি পেয়েছিল কিংবা সব ম্যানুয়াল সুরক্ষিত অবস্থায় এর আসল বাক্সে করেই কার্তুজ এসেছে কি না ইত্যাদি বিষয় এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, 'মহামূল্যবান' রেট্রো গেমসগুলো অবমুক্ত অবস্থায় থাকে এবং সেগুলো একেবারে প্রথম দিককার সংস্করণের একটি হতে হবে। প্যাকেট খুলে ফেললেই গেমসের মূল্য অর্ধেক কমে যায়, জানালেন ডিলন।
গ্রেডিং প্রক্রিয়া চালু হওয়ার ফলে ক্রেতাদের বেশ সুবিধাই হয়েছে। এখন তারা সহজেই কেনার আগে গেমসের মান যাচাই করতে পারেন। একসময় গেম সংগ্রহ শুধু ইবে, রেডইট বা ফেসবুক গ্রুপগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে হাই-প্রোফাইল নিলাম প্রতিষ্ঠানগুলো এগুলোর দাম বাড়াতে সাহায্য করছে। কারণ নতুন সংগ্রাহক থেকে ধরে শিল্প বিনিয়োগকারী কিংবা কমিক বই ও ট্রেডিং কার্ডপ্রেমী; তারাও এখন গেমস সংগ্রহের দিকে ঝুঁকছেন।
বিলাসপণ্য নিলামকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাসি অ্যান্ড সন্সের প্রধানকর্তা ইলিয়ানা বডনার-হোর্ভাথ জানান, রেট্রো ভিডিও গেমস সংগ্রহে অনলাইন বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখে বুঝা যায়, তারা এখন 'প্রথাগত' জিনিসের বাইরে গিয়ে কিছু একটা সংগ্রহে রাখতে চাইছেন। এই তালিকায় রয়েছে স্নিকারস, ট্রেডিং কার্ড বা নন ফিউজেবল টোকেনের মতো বস্তু।
'সম্প্রতি আমরা খেয়াল করেছি, আমাদের ক্লায়েন্টরা আরও বিরল ও অদ্বিতীয় বস্তু নিয়ে কাজ করতে চাইছেন। রিয়েল এস্টেট কিংবা স্টকের মতো প্রথাগত জিনিসের প্রতি আগ্রহ সবসময়ই থাকবে। কিন্তু এখন বিকল্প বস্তুগুলোও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে,' বলেন ইলিয়ানা।
সীমিত আকারে উৎপাদিত গেমসের চেয়ে জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজির ক্লাসিক টাইটেলের গেমগুলো নিলামে বেশি দামে বিক্রি হয়। ডিলনের মতে, এর কারণ, এসব গেমসের চরিত্রগুলো বহু বছর ধরে মানুষের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় এবং তাদেরকে নস্টালজিয়ায় নিয়ে যায়। এই যেমন- মারিও, 'ফাইনাল ফ্যান্টাসি টু'র ক্লাউড স্ট্রাইফ কিংবা জেলডা।

এই সংগ্রহের ভবিষ্যত কেমন?
বর্তমানে গেমিং শিল্প শুধুমাত্র ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিক্রির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। হয় স্টিমের মতো থার্ড পার্টির মাধ্যমে কিংবা প্লেস্টেশন নেটওয়ার্ক ও নিনটেন্ডো ডিরেক্টের মাধ্যমেই এখন গেমস বিক্রি হচ্ছে। নিজের কাছে গেমের একটা কপি রাখা এখন সুদূর অতীত।
কিন্তু গেম ডেভেলপাররা ইতোমধ্যেই পরবর্তী প্রজন্মের নস্টালজিক ব্যক্তিদের দিকে নিশানা স্থির করে রেখেছেন! অনেকেই এক্সক্লুসিভ আর্টওয়ার্ক বা সাউন্ডট্র্যাক সম্বলিত বিশেষ ডিজিটাল সংস্করণ রেখে দিচ্ছেন। অন্যরা আবার সরাসরি গেম মুক্তি দিচ্ছেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সম্প্রতি ইউবিসফট 'অ্যাসাসিন'স ক্রিড: অরিজিনস' নামক গেমের একটি 'কিংবদন্তি সংস্করণ' প্রকাশ করেছে, যার মূল্য ৮০০ ডলার। এই সংস্করণে থাকছে গেমের মূল চরিত্রের একটি ২৯ ইঞ্চি লম্বা রেজিন ভাস্কর্য, স্টুডিওর শিল্পীদের স্বাক্ষর করা লিথোগ্রাফ এবং হাতে আঁকা একটি বিশ্ব-মানচিত্র। এটির প্রায় এক হাজার কপি ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে চলে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে ডিলন বলেন, 'আজ থেকে ২০ বছর পর আজকের শিশুরা তাদের ছেলেবেলার গেমস পুনঃনির্মাণ করতে চাইবে। তখন যেগুলো মুক্তি পেয়েছিল, তা হয়তো তখন তারা কেনেনি।' তাই বিশ বছর পরেও নিদর্শন হিসেবে আবার সেসব গেমস যে চড়া দামে বিক্রি হবে, সে সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।
তবে ডিলন কিন্তু খুব শিগগিরই তার সংগ্রহ বিক্রি করছেন না। নিজের মৃত্যুর আগে তিনি এই সংগ্রহ এমন কারও হাতে দিয়ে যেতে চান, যে এগুলোর কদর বুঝবে।
-
সূত্র: সিএনএন