দুর্গম পাহাড়ে আলোর কাণ্ডারি থানজুয়াল বম

'শিক্ষকতার পেশায় খুব একটা পরিকল্পনা করে আসা হয়নি। সুযোগ পেয়ে শিক্ষকতায় ঢুকে গেলাম। কিন্তু শিক্ষকতায় এসে এটাকে অন্য আর দশটার পেশার মত মনে হয়নি। শিশুদের মনস্তত্ত্ব বুঝে তাদের ঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারলে এ পেশার সার্থকতা নাই।'
উপরের এই কথাগুলো বান্দরবানের সদর উপজেলা ক্যচিংঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক থানজুয়াল বমের। তিনি শিক্ষার প্রতি নিবেদিত প্রাণ হওয়ায় ২০১১ সালে বান্দরবানে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হন। বর্তমান কর্মস্থল ক্যচিংঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আগে আরও কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন।
'শিক্ষকতার শুরুতে রুমা উপজেলা খুবই দুর্গম এলাকায় একটা স্কুলে ছিলাম। স্কুলটি সদর উপজেলা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ি রাস্তা। যানবাহনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। হেঁটে যেতে হতো। আসা-যাওয়াতেই সারাদিন চলে যেত,' বলেন থানজুয়াল বম।
'খুব ক্লান্ত লাগত। কিন্তু শিক্ষকতা ছেড়ে দেইনি। পরে ডেইলি যাতাতয়াত না করে, ওই এলাকাতেই ঘর ভাড়া নিয়ে থেকেছি। শুধুমাত্র দুর্গম এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে এই কষ্টগুলো করেছি।'

থানজুয়াল বম আরও বলেন, 'এরপর ২০১১ সালে বান্দরবান সদর উপজেলা এমন একটা স্কুলে যোগদান করি। যেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল অনিয়মিত। পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক ছিল না। স্কুলের অবস্থা ছিল একেবারে ভাঙ্গাচোরা।
'স্কুলটাকে সম্পূর্ণভাবে নতুন করে পরিচালনা করি। স্কুলের অভিভাবকদের সাথে নিয়মিত সভা করতাম। পড়াশোনার মান উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেই। ওই বছরই আমার সুয়ালক স্কুল থেকে প্রথমবারের মত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় কিছু শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। ওই বছরই আমাকে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচন করা হয়।'
শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ার পর থানজুয়াল বম বিদেশে সফরে যান। ২০১৬ সালে সরকারিভাবে সাত দিনের থাইল্যান্ড পাঠানো হয় তাকে। এই সফরে তিনি থাইল্যান্ডের বিভিন্ন স্কুলের অনেক কিছু জানার সুযোগ পান।
থানজুয়াল বমের জন্ম রুমা উপজেলায়। তিনি বান্দরবান সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন । স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে। এছাড়া চট্টগ্রাম টির্চাস ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড কোর্স সম্পন্ন করেছেন। ব্যক্তিজীবনে দুই সন্তানের মা তিনি।

শিক্ষার জন্য তিনি দুরত্বকে কখনই বাধা মনে করেননি। যে কারণে প্রয়োজন হলে, আবারও কোনো দুর্গম এলাকা গিয়ে শিক্ষকতা করার আগ্রহ আছে থানজুয়াল বমের। দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাডকে তিনি এই আগ্রহের কথা বলে জানান, 'নিজের ছোট বাচ্চা থাকায় আবেদন করে জেলা সদরে একটা স্কুলে এসেছি। ভবিষ্যতে দুর্গম এলাকা এবং কোনো অনগ্রসর পাড়ায় গিয়ে শিক্ষকতা করব।'
পাহাড়ী শিশুদের পড়াশোনার সমস্যা অনেক। এরমধ্যে মূল হল: দুর্গমতা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা এবং ভাষাগত সমস্যা। এই কটি কারণে পাহাড়ের শিশুরা পিছিয়ে আছে বলে মনে করেন থানজুয়াল।
থানজুয়াল বম শিক্ষকতার বাইরেও নানান সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন বম জনগোষ্ঠীর সামাজিক সংগঠন বম সোস্যাল কাউন্সিলের মহিলা শাখা বম উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।
তিনি জানান, বিভিন্ন সময় বম মহিলারা নানা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আসেন তার কাছে। বিশেষ করে বম সমাজে নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে ঝামেলা আছে। নারীদের অধিকার বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটে। আবার অসুস্থতাজনিত আর্থিক সংকটও আছে। এসব বিষয়ে মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন থানজুয়াল বম সব সময়ে।

রুমা উপজেলার দুর্গম এক এলাকার অনাথ ছাত্র বিয়াকনুনমাওয়াই বম জানান, বাবা-মা হারিয়ে একসময় পড়াশুনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার। পরে এই শিক্ষকের সহযোগিতায় এখনও পড়াশুনা করে যাচ্ছে সে।
থানচি উপজেলার দুর্গম রেমাক্রির বাসিন্দা সিয়ামফেন বম র্দীঘদিন ধরে রক্তশূণ্যতার রোগে ভোগার পর উন্নত চিকিৎসা পেয়ে এখন সুস্থ। এই সিয়ামফেন বম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে থানজুয়াল বমের কথা।
'রক্তশূণ্যতা রোগসহ নানা জটিল রোগে ভুগছিলাম আমি। দেখার কেউ ছিল না। পরে থানজুয়াল বম বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করে আমাকে উন্নত চিকিৎসা করিয়েছেন।'
সুয়ালক এলাকার বাসিন্দা মং এ মারমা বলেন, 'তার শিশুদের পড়ানোর ধরণ এবং সহজে তাদের আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল অনেত। ওই ম্যাডাম যে স্কুলে স্কুলে যান কয়েক বছরে মধ্যেই সে স্কুলের শিশুদের পড়াশুনার মান উন্নয়ন ঘটে।'