দুই লিও’তে আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়

দুজনেরই নামের প্রথম অংশে লিও; লিওনেল স্কালোনি ও লিওনেল মেসি।। একজন স্বপ্ন দেখানোর কারিগর, আরেকজন বাস্তবায়নের। এই যুগলের রসায়ণটা জমলো বেশ, অন্য স্বপ্নসারথীরাও জান লাগিয়ে দিলেন। শুরুটা দুঃস্বপ্নের হলেও পরের ধাপগুলো হলো ঝলমলে, দাপুটে আর ঐতিহাসিক। ৩৬ বছরের অপেক্ষা ফুরিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরলো আর্জেন্টিনা।
মেসি আর্জেন্টিনার স্বপ্নবাহক কিংবা স্বপ্ন ছোঁয়ার কারিগর অনেকদিন ধরেই। সেই ২০০৫ সালে জাতীয় দলে নাম লেখান, কয়েক বছরের মধ্যেই পরিণত হন প্রাণ ভোমরায়। এর পর পর থেকে খুদে এই জাদুকরকে ঘিরেই আবর্তিত হয় আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্বপ্ন। একবার খুব কাছেও চলে গিয়েছিলেন মেসি। কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপের সেই ফাইনাল বিষাদমাখা গল্প হিসেবেই রয়ে যায়।
সেবার জাদুকরী পারফরম্যান্সে দলকে ফাইনালে তুলেও হতাশায় বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয় মেসির। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নিঃশ্বাস দূরত্বে গিয়ে ঝলঝল চোখে শিরোপা দিকে তাকিয়ে থাকা মেসির ছবি দেখে মন ভেঙেছিলো হাজারও আর্জেন্টাইন সমর্থকের। ৮ বছর পর এসে সেই দৃশ্যটা এবার উদযাপনে রূপ দিলেন মেসি। ৩৫ বছর বয়সেও দূরন্ত কিশোরের মতো মাঠ কাঁপিয়ে দুর্বার মেসি ছুঁয়ে দেখলেন বিশ্বকাপ শিরোপা।
রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে ফ্রাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে দেশের এবং নিজের দীর্ঘ দিনের অপেক্ষা ঘুচিয়ে মেসি পা রাখলেন অমরত্বের আঙিনায়। লম্বা ক্যারিয়ারে ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে অসংখ্য কীর্তি গড়া আর্জেন্টাইন এই ফুটবল বিস্ময়ের কমতিটাই যে ছিল একটি বিশ্বকাপ শিরোপা। পঞ্চম বিশ্বকাপে সেটা পুষিয়ে নিলেন মেসি, নাম তুললেন বিশ্বজয়ীদের কাতারে। যেখানে তিনিই থাকলেন নেতা, ভরসার জায়গা।
আলবিসেলেস্তেদের বিশ্বজয়ের মিশনে গোল করে, সতীর্থদের দিয়ে করিয়ে মেসি হয়ে উঠলেন আরও অনন্য, সম্ভবত সর্বকালের সেরাও। পর আরাধ্যের সোনালী শিরোপা ছুঁয়ে দেখার মিশনটি মেসির জন্য হয়ে ওঠে রেকর্ডময়। প্রায় প্রতি ম্যাচেই একের পর মাইলফলক ছাড়িয়েছেন রেকর্ড সাতবারের ব্যালন ডি'অর জয়ী, গড়ে গেছেন কীর্তি।
এবারের বিশ্বকাপে মেসি গোল করেছেন ৭টি, সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে তার গোলসংখ্যা ১৩টি। যা আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এ পথে তিনি এবার ছাড়িয়ে গেছেন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনা ও গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে। বিশ্বকাপের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় মেসির অবস্থান এখন যৌথভাবে চতুর্থ, ১৩ গোলের মালিক ফ্রান্সের জাস্ট ফন্তাইনও।
গোন্ডেন বুট জেতার লড়াইয়ে ভালোভাবেই ছিলেন মেসি। শেষ লড়াইটা হয়েছে ফাইনালে। একবার মেসি এগিয়ে যান তো আরেকবার কিলিয়ান এমবাপ্পে। শেষ পর্যন্ত জোড়া করা মেসিকে ছাড়িয়ে যান হ্যাটট্রিক হিরো এমবাপ্পে। ৮ গোল নিয়ে সোনার জুতো পায়ে তুলেছেন ফরাসী এই ফরোয়ার্ড। তবে গোলের সঙ্গে ৩টি অ্যাসিস্ট করানোয় গোল্ডেন বলটা শোভা পেয়েছে মেসির হাতে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার হিসেবে দুটি আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন আর্জেন্টাইন এই কিংবদন্তি।
ফাইনাল খেলতে নেমে আরও কিছু রেকর্ড নিজের করে নেন নিয়েছেন মেসি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড এখন তার। সেমি-ফাইনালে ২৫তম ম্যাচ খেলে জার্মানির লোথার ম্যাথাউসের সঙ্গে এই রেকর্ড ভাগাভাগি করেন মেসি। ফাইনালে নামার সাথে সাথে রেকর্ডটি মেসির একার হয়ে যায়, বিশ্বকাপে ২৬টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মিনিট খেলা ফুটবলারও এখন মেসি। ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ২৩ মিনিট খেলার পরই রেকর্ড তার হয়ে যায়। রেকর্ডটি এতোদিন দখলে রাখা পাওলো মালদিনি খেলেছেন ২ হাজার ২১৭ মিনিট। মেসি খেলেছেন ২ হাজার ৩১৪ মিনিট।
আরেকটি বড় রেকর্ডে রাজার আসনে বসেছেন মেসি। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোলে যুক্ত থাকার রেকর্ড এখন আর্জেন্টাইন এই ফরোয়ার্ডের। ফাইনালের আগে বিশ্বকাপে ১৯টি গোলে যুক্ত থেকেছেন মেসি (গোল করা+করানো), যা বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ। ফাইনালে দুটি গোল করে নিজেকেই আরও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি।
আর্জেন্টাইনদের আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা লিওনেল স্কালোনি। যার জাদুকরী ছোঁয়ায় বদলে গেছে আর্জেন্টিনা, পরিণত হয়েছে শক্তিধর ফুটবল দলে। ছয়টি ব্যর্থ চেষ্টার পর তার হাত ধরেই ২৮ বছর পর শিরোপার হাসি হাসে লাতিন অঞ্চলের এই ফুটবল পরাশক্তি। তার অধীনে সর্বশেষ ৪৩ ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে হেরেছে আর্জেন্টিনা, সেটা এবারের বিশ্বকাপে সৌদি আরবের বিপক্ষে।
২০১৮ বিশ্বকাপে শেষ ষোলো থেকে বিদায় নেওয়ার পর আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে হোর্হে সাম্পাওলির স্থলাভিষিক্ত হন স্কালোনি। দুই বছরের মাথায় কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতা ৪৪ বছর বয়সী এই কোচ পরে জেতেন ফিনিলাসিমাও। ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে সহজেই হারিয়ে আরেকটি শিরোপা জেতে আলবিসেলেস্তেরা। তার ছোঁয়াতেই বদলে যাওয়া আর্জেন্টিনা ২০১৯ কোপার সেমি-ফাইনাল হারার দুর্বার গতিতে চোটে, বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত অপরাতি থাকে ৩৬ ম্যাচে।
আক্রমণভাগে সব সময়ই শক্তিশালী ছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু মাঝমাঠ ও রক্ষণভাগের দুর্বলতায় গোল হজম করতে হতো তাদের। কোচ হিসেবে এই জায়গায় পরিবর্তন করাটা ছিল স্কালোনির প্রথম পদক্ষেপ। সাফল্যের পথ মারাতে বয়সী খেলোয়াড়দের বিদায় জানিয়ে তরুণ ও শিখতে ক্ষুধার্ত ফুটবলারদের দলে আর্জেন্টাইন এই কোচ।
গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেস, সেন্টার-ব্যাক ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো এবং মিডফিল্ডার রদ্রিগো দি পলের সমন্বয়ে আর্জেন্টিনা দলের শক্ত মেরুদণ্ড তৈরি করেন স্কালোনি, তাতে দলের চেহারাই বদলে যায়। অথচ ২০১৮ সালে অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব নেওয়ার সময় প্রধান কোচ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাই ছিল না তার। সে সময় যুব কার্যক্রমের দায়িত্বে ছিলেন স্কালোনি। সেই তিনিই চার বছরের মধ্যে বিশ্বসেরা কোচ। এবারের বিশ্বকাপে স্কালোনির খেলানোর ধরন, কৌশলগত দিক ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।
স্কালোনিকে নিয়ে আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের মুগ্ধতার শেষ নেই। বিশ্বকাপ শুরুর আগে কোচকে নিয়ে মেসি বলেছিলেন, 'স্কালোনি আমাদের একজন। তিনিই জাতীয় দল নির্বাচন করেছেন। তিনিই সেই মানুষটা, যিনি বিশ্বাস করেছিলেন, কঠিন মুহূর্তে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি আমাদের আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন, দলে নতুন মানুষ নিয়ে এসেছেন। তিনি সব সময় জানতেন যে তিনি কী চান, আর আমরা বড় হয়েছি। ২০১৯ কোপা আমেরিকা থেকে আমরা বড় একটি লাফ দিয়েছি।'
আরও একবার বিশ্বাস রেখেছেন স্কালোনি, আরও একবার সেটার প্রতিদান দিয়েছেন আর্জেন্টিনারর ফুটবলাররা। যেখানে নেতা হয়ে পথ দেখিয়েছেন সর্বকালের সেরা ফুটবলারের বিতর্কে ইতি টেনে দেওয়া লিওনেল মেসি। দুই লিও'তে বিশ্বজয় করার আনন্দে মেতেছে আর্জেন্টিনা।