বিশ্বকাপ আসরে সাড়া জাগানো যত অঘটন

ফুটবলের মহারণ– বিশ্বকাপ। এর প্রতি আসরেই থাকে অঘটন আর বিস্ময় জাগানিয়া কিছু ঘটনা, যার কোনো কোনোটি চিরকালীন ছাপ রেখে যায় ক্রীড়া ইতিহাসে। বিশ্বকাপ যাত্রায় সব দলেরই চেষ্টা থাকে এগিয়ে চলার। প্রতি ম্যাচে যেমন থাকে হট ফেভারিট, তেমনি প্রতি আসরেও সেরা হিসেবে এগিয়ে থাকে কিছু দল। তবু প্রতিযোগিতার এ আসরে রণাঙ্গনের মতোই যেকোনো সময় ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা।
যেমন অপ্রত্যাশিতভাবে আজ মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) সৌদি আরবের বিপক্ষে ২-১ গোলের ব্যবধানে হার হয়েছে আর্জেন্টিনার। ভক্ত-সমর্থকদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল হট-ফেভারিট দলটির বিশ্বকাপ অভিযান এভাবে শুরুর দৃষ্টান্ত।
আল জাজিরা অবলম্বনে, বিশ্বকাপ আসরের এমন কিছু হতবাক করে দেওয়ার মতো জয়-পরাজয়ের ঘটনা তুলে ধরতেই এ আয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র ১ - ইংল্যান্ড ০ (১৯৫০)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজনটি ছিল ১৯৫০ সালের। প্রথমবারের মতো তাতে খেলার সুযোগ পায় ইংল্যান্ড। কিন্তু, ফর্মের কারণে দলটির হাতেই সেবারের শিরোপা যাবে এমন ধারণাই করা হয়েছিল।
অন্যদিকে, মার্কিন দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় ছিলেন পার্ট-টাইমার। অর্থাৎ, তারা পুরোদস্তুর পেশাদার ফুটবলার ছিলেন না। এমনকী একজন 'ডিশওয়াশার'ও ছিলেন দলে। একজন ছিলেন ডাক বাহক, আরেকজন স্কুল শিক্ষক। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের আগে মাত্র একদিন অনুশীলনের সুযোগ পায় মিশ্র পেশার এই দলটি।
কেউ ভাবেনি এই জগাখিচুড়ি দলই রচনা করবে ইতিহাস। তবু তার সাক্ষীই হলো- এসটাডিও ইন্ডেপেন্ডেসিয়া স্টেডিয়াম। ২৯ জুনের ওই গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ১-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নাম লেখায় ইতিহাসের পাতায়। দলের হয়ে একমাত্র গোলটি করেছিলেন হাইতির বংশদ্ভূত মার্কিন সেন্টার ফরোয়ার্ড জো গায়েজেন্স।
পশ্চিম জার্মানি ৩- হাঙ্গেরি ২ (১৯৫৪)
বিশ্বকাপের পরের আসরে হট- ফেভারিট ছিল হাঙ্গেরি। আগের ম্যাচগুলিতে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৯-০ এবং পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলের বড় ব্যবধানে হারিয়ে সেই প্রত্যাশাকে তুঙ্গে রেখেছিল দলটি।
ফাইনালে আবারো পশ্চিম জার্মানিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় হাঙ্গেরি। আশা ছিল, এবারও হবে আগের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি। ম্যাচের প্রথমভাগে তার প্রতিফলনও দেখাচ্ছিল তারা, কিন্তু সে অগ্রগতি থমকে যায় পশ্চিম জার্মানি দুটি গোল স্কোর করার পর।

৮৪ মিনিট পর্যন্ত সমতা ছিল ম্যাচের ফলাফলে। এরপর নিজের দ্বিতীয় এবং দলের তৃতীয় গোলটি করে হাঙ্গেরির সমর্থকদের হৃদয় ভাঙ্গলেন পশ্চিম জার্মানির হেলমুট রান। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম এই সেরা দলের বিপক্ষে পশ্চিম জার্মানির ঘুরে দাঁড়ানো এবং শিরোপ জয়ের ঘটনাকে পরবর্তীতে 'দ্য মিরাকল অভ বার্ন' বলে অভিহিত করা হয়।
উত্তর কোরিয়া ১- ইতালি ০ (১৯৬৬)
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সেবারের বিশ্বকাপে উত্তর কোরিয়া দল যোগ দেওয়াটাই ছিল এক চমক। কিন্তু, পিলে চমকানো তখনও ছিল বাকি।

উ. কোরিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে ইতালির মিডফিল্ডার জিয়াকোমো বুলগারেল্লির প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু, ম্যাচ চলাকালে ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। তখন বিশ্বকাপের নিয়ম অনুসারে, বিকল্প খেলোয়াড় নামানোর নিয়ম না থাকায় ১০ জনের দল নিয়েই লড়তে থাকে ইতালি।
বুলগারেল্লি চলে যাওয়ার সাত মিনিট পরই চমক দেখায় উ. কোরিয়া। পাক দো ইক- এর দেওয়া গোলে নিশ্চিত হয় জয়। আর দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে নক আউটে বাদ পড়ার তিক্ত স্বাদ তিনিই দেন।
আলজেরিয়া ২- পশ্চিম জার্মানি ১ (১৯৮২)
ইউরোপের তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানি। সঙ্গে আগের দুটি বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড অর্জন তো ছিলই। বলাইবাহুল্য সেবার তারাই ছিল অন্যতম ফেভারিট।

প্রাণবন্ত ছিল আলজেরিয়া দলও। বিশ্বকাপে পা রাখার আগে তারা বেশিরভাগ ম্যাচেই করে দুর্দান্ত পারফর্ম।
তবু আত্মপ্রসাদেই হয়তো ভুগছিল জার্মানরা, যার মাসুলে দিতে হয় তাদের। স্পেনের এল মিঁলো স্টেডিয়ামে ৬৯ মিনিটের মাথায় আলজেরিয়ার হয়ে জয় নিশ্চিতকারী গোলটি করেন লাখদার বেলৌমি।
ক্যামেরুন ১- আর্জেন্টিনা ০ (১৯৯০)
১৯৯০ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে সাব-সাহারা অঞ্চলের একমাত্র আফ্রিকান দেশ ছিল ক্যামেরুন।

ম্যাচের শুরুটা সাবলীল ছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু, সময় যতই গড়াতে থাকে, বাড়তে থাকে ক্যামেরুনীয়দের আত্মবিশ্বাস। আর্জেন্টিনার আক্রমণও রুখে দিতে থাকে।
এভাবে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি ফ্রি কিকের সুযোগ পান ফ্রান্সিস ওমাম- বিয়িক। আর তাতেই কেল্লাফতে। শেষ হুইসেল বাজার আগে সেই গোল আর শোধ করা হয়নি আর্জেন্টিনার।
ফ্রান্স ০- সেনেগাল ১ (২০০২)
২০০২ সালের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে দারুণ খেলছিল দুই দলই। ম্যাচটি থেকে এমন প্রত্যাশাই ছিল ফুটবল বোদ্ধাদের। কিন্তু, তারা বা এমনকি ফ্রান্স দলও বুঝতে পারেনি– কী নিপুণ ছক নিয়ে এগোচ্ছে সেনেগাল। ফরাসী আক্রমণ রুখতেই তারা কৌশলী হয়।

মাঠে বিদ্যুতের ঝলক দেখাচ্ছিলেন এল হাজি দিউফ। আর ৩০ মিনিটের মাথায় ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন পাপা বৌদা দিউপ। ৯০ মিনিটের ম্যাচের অধিকাংশ সময় মাঠে আধিপত্য করে জয় পায় সেনেগাল।
ফ্রান্সের ভাগ্য সেবার মন্দই ছিল। আরেকটি হার ও ড্রয়ের পর শেষ হয় তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা। অন্যদিকে, ইতিহাসের দ্বিতীয় আফ্রিকান দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তীর্ণ হয় সেনেগাল।
জার্মানি ৭- ব্রাজিল ১ (২০১৪)
২০১৪ সালের বিশ্বকাপ শিরোপা ষষ্ঠবারের মতো ব্রাজিলের ঘরে উঠবে বলেই ধারণা করা হচ্ছিল।

কিন্তু, মানুষ ভাবে এক- হয় আরেক। স্বপ্ন ভাঙতে দেরি হয়নি ব্রাজিলের। জার্মানির সাথে ম্যাচেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে সোনালী ট্রফি ঘরে তোলার আশা। ম্যাচের ১১ মিনিট না গড়াতেই গোল জালে জড়াতে থাকে জার্মানি, তারপর একদণ্ডও বিরাম নেয়নি। হাফ টাইমের ছয় মিনিট আগপর্যন্ত করে আরও চারটি গোল। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ, অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন ব্রাজিল ভক্তকূল।
হাফ টাইমের পর আরও গঞ্জনা অপেক্ষা করছিল ব্রাজিলের কপালে। আরও দুবার তাদের রক্ষণভাগ গুঁড়িয়ে গোল দেয় জার্মানি। ম্যাচের একদম শেষমুহূর্তে সান্ত্বনাসূচক একমাত্র গোলটি করে ব্রাজিল। ১৯২০ সালের পর এটাই ছিল ব্রাজিল দলের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে পরাজয়।