মিখাইল তাল: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আক্রমণাত্মক দাবাড়ু!

আচ্ছা, দাবা মানেই কি বিরক্তিকর একঘেয়ে খেলা? দাবার বোর্ডে কি শুধুই ভারিক্কি চেহারার রাশভারী সব বুড়ো লোকেরা বসে থাকে, আর ঘণ্টায় মাত্র একটা করে চাল দেয়? যদি এমনটাই ভেবে থাকেন, তবে মিখাইল তাল আপনার কাছে এক ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরা দেবেন!
দাবার ইতিহাসের অষ্টম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তাল ছিলেন এমন এক দাবাড়ু যাকে বলা হয় ওয়ান অভ আ কাইন্ড; গণমানুষের প্রিয় দাবাড়ুতেও পরিণত হয়েছিলেন তিনি। দাবাকে শুধু পজিশনাল খেলা থেকে বের করে আনেন তাল। যুক্ত করেন গতি, আক্রমণ আর চোখধাঁধানো সব চাল। যা দর্শকদের কাছে ছিল দৃষ্টিনন্দন আর আকর্ষণীয়। সেসময় সোভিয়েতদের ঘরে ঘরে তালের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল, তাল ছিল এক আদর্শের নাম!
তাল-পরবর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আনাতোলি কারপভ তার সম্পর্কে বলেন, সেরা সময়ের তালকে নিয়ে বলতে গেলে একটা কথাই বলতে হয়, 'এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন!' তাল ইতিহাসের সবথেকে কম সময় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন। মাত্র ১ বছর ৫ দিনের এই ছোট্ট সময়টাতে তিনি বলতে গেলে দাবার ভিতই নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাল যখন কেবল উদীয়মান দাবাড়ু, মিখাইল বটভিনিক সেসময়ের প্রতিষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন। বটভিনিকের শান্ত, ধীর-স্থির ধরনের বিপরীতে তাল নিয়ে এসেছিলেন এক জাদুকরী ধরন, যার আক্রমণের সামনে সবকিছু ভেঙে পড়ে।
তাল বোর্ডে খুব হেঁয়ালি আর ধোঁয়াশা তৈরি করতে পছন্দ করতেন। তার বিখ্যাত উক্তি—'আপনাকে আপনার প্রতিপক্ষকে দাবার বোর্ডে এক গভীর, ঘন জঙ্গলে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে দুয়ে দুয়ে পাঁচ হয়! সেখান থেকে বেরোবার রাস্তাটা যেন কেবল একজনেরই বাকি থাকে।'
জন্ম ও দাবাজগত অধিগ্রহণের শুরুর পর্ব
মিখাইল নেখমেভিচ দ্য এইটথ, তাল জন্মেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের লাটভিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী রিগায়। ১৯৩৬ সালের ৯ নভেম্বর। বাবা ছিলেন ডাক্তার, সাথে দাবাটাও পারতেন বেশ ভালোই; ছেলেকে শিখিয়েছিলেন মাত্র ৬ বছর বয়স হতেই। কে জানত, এই ছেলে পরবর্তীতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে! ছোটবেলায় আর দশটা শখের মতোই তাল নিয়েছিলেন দাবাকে, এমনকি একপর্যায়ে ড্রামা বা নাটকে তার আগ্রহ দাবাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দিন যতই এগোতে থাকে, নেশার বোঝা বাড়তে থাকে,দাবায় ফেরেন তাল।
তালের নিজের ভাষ্যে, 'দাবায় আসক্ত হওয়া কিছুটা রোগের মতো, যেমন হংকং ফ্লু। প্রথমদিকে কিছু ম্যাচ জিতলে বা হারলে আপনার কিছু মনে হবে না, কিন্তু একটা সময় গিয়ে দাবা ছাড়া জীবনকে মনে হবে অপূর্ণ; কিছু একটা যেন আপনার জীবনে নেই। ধীরে ধীরে আপনি এমন একজনে পরিণত হবেন, দাবার ব্যাধির প্রতিরোধক যার ইমিউন সিস্টেমে নেই।'

রতনে রতন চেনে বলে একটা কথা আছে না, অ্যালেকজান্ডার কোব্লেন্তজ আপনাকে মনে করিয়ে দেবে সেই কথাই। তালের দাবা ক্যারিয়ারের প্রথম কোচ তথা গুরুর ভূমিকা পালন করেছিলেন এই ভদ্রলোক। তার শিক্ষাতেই শেষ পর্যন্ত রাজসিংহাসনটি নিজের করে নিয়েছিলেন তাল! ১৬ বছরে শুরু, লাটভিয়ান চ্যাম্পিয়ন হতে এর বেশি বয়স লাগেনি মিশার। মিখাইল তালের বেশ অনেকগুলো ডাকনাম আছে। দ্য ম্যাজিশিয়ান ফ্রম রিগা, দ্য পাইরেট অফ লাটভিয়া, দ্য ফরচুনস ফেবারিট, দ্য হিপনোটিস্ট, দ্য এলিয়েন...আরও কত কী! আর বন্ধুদের কাছে যিনি ছিলেন শুধুই মিশা, বিলাভেড (প্রিয়) মিশা!
সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপ চলে এল হাতের মুঠোয়
স্বভাবে মাত্রিতিরিক্ত দুরন্ত হলেও দাবার সাথে সাথে পড়াশুনাটাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাল। ১৯৫৭ সালে রিগা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও দর্শনে একত্রে স্নাতকোত্তর লাভ করেন তিনি। একই বছর রেকর্ড গড়ে জেতেন ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপ! প্রায় অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ছিল এটা, কারণ লাইন-আপে ছিলেন পল কেরেস, ডেভিড ব্রন্সটেইন, ভিক্টর করচনোই, তিগ্রান পেত্রসিয়ান প্রমুখের মতো বাঘা বাঘা দাবাড়ু। তালের আগে এত কম বয়সে কেউ ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেননি। আশ্চর্য হয়ে ফিদে তাকে দিয়ে বসল গ্র্যান্ডমাস্টার টাইটেল। অথচ মিশা তখনও এর আগের টাইটেল—যেমন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার (আইএম) এসবের নর্মগুলোই পাননি! (নর্ম দেয়া হয়, টাইটেল পাওয়ার ধাপে ধাপে। যা একজন দাবাড়ুর শক্তিমত্তার পরিধি বোঝায়।)
শুধু তাই নয়, তাল এর পরের বছরও ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপ নিজের করে নেন। এখন আপনাআপনি লক্ষ্য হয়ে যায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ। কিন্তু ওখানে খেলতে হলে আগে কোয়ালিফাই করতে হয়। সেই ধাপের অংশ হিসেবে ১৯৫৮ সালে তাল ইন্টারজোনাল টুর্নামেন্ট জয় করেন। অবশেষে ১৯৫৯ সালে ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্ট জয় করলে আর কোনো বাধা থাকল না! পরের বছর মিখাইল বটভিনিকের সাথে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে লড়ার যোগ্যতা অর্জন করে ফেললেন তাল।
ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট হলো এমন এক টুর্নামেন্ট, যেখানে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বী বা ক্যান্ডিডেট বাছাই করা হয়! সেখানে তাল সলিড ফর্ম দেখান। স্কোরলাইন ছিল +১৬ -৪ =৮। এখানে প্লাস দিয়ে জয়, মাইনাস দিয়া পরাজয়, আর ইকুয়াল দিয়ে ড্র বোঝায়। এর মাঝে আবার ছিল পরবর্তী মার্কিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ববি ফিশারের বিপক্ষে বিধ্বংসী ৪/৪ অর্থাৎ সবগুলো গেমেই বিজয়! ইন্টারজোনালে তো তাল ছিলেন এর থেকেও অপ্রতিরোধ্য (+৯ -১ =১০)!
খেলার ধরন—স্যাক্রিফাইসিং ও আক্রমণ
স্যাক্রিফাইসকে অন্য এক শৈল্পিক মাত্রা প্রদান করেন তাল। দাবায় কোনো ঘুঁটি যখন চালা হয়, তখন সাধারণত তার প্রটেকশন হিসেবে এক বা একাধিক ঘুঁটি থাকে তাকে প্রতিপক্ষের ঘুঁটি থেকে রক্ষা করবার ঢাল হিসেবে। আর যখন আপনি কোনো পিস একদম সপাটে বিলিয়ে দিয়ে আসেন কোনো প্রতিরক্ষা ছাড়াই, একে বলা হয় ব্লান্ডার। কিন্তু যদি এই ঘুঁটি বিলিয়ে দেয়ায় আখেরে কোনো লাভ থাকে, হোক সেটা পজিশনাল গেম-প্লে বা ঘুঁটির সংখ্যায়, সেটাকে তখন বলা হয় স্যাক্রিফাইস। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে গিয়ে ফল পেলে এটা আর তখন ভুল খেলা থাকে না, হয়ে যায় ব্রিলিয়ান্ট মুভ! দাবার ঠিক এই শাস্ত্রই পুনর্গঠন করে উল্টেপাল্টে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন মিখাইল তাল।
তালের দাবার গতি কতটা আক্রমণাত্মক, তার ধারণা মিলবে তার উক্তিতেই—'সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলতে নেমে আপনি যদি ড্রয়ের লক্ষ্যে আগান, তবে এটি নিশ্চয়ই দাবার বিরুদ্ধে একরকমের অপরাধ!'
বিনোদন, নান্দনিকতা, নাটকীয়তা আর সমন্বয়ের মিশেলে এক পরাবাস্তব দাবা খেলতেন তাল। তালের সাথে একমাত্র তুলনা করা যায় মার্কিন দাবাড়ু পল চার্লস মরফির। তাল ছিলেন রাশিয়ান দাবাড়ু আলেকজান্ডার অ্যালেখাইনের মতো—দাবার একমাত্র বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, যিনি অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন অবস্থায় মারা যান। তাল ছোট-বড় যেকোনো পিস স্যাক্রিফাইস করে পজিশন এমন জটিল করে তুলতেন যে প্রতিপক্ষ কিছু বুঝে ওঠারই সুযোগ পেত না। আর এভাবে উপর্যুপরি অআক্রমণ করতে থাকলে কিছু ছোটখাটো ভুল চাল হবেই, কিন্তু তাল সেসবের থোড়াই কেয়ার করতেন! তালের মতে, 'দাবার বোর্ডে ভুল চাল অবশ্যই ভালো নয়, তবে ভুল সবসময় এড়ানোও যায় না। বাকিদের মতে যেটা ভুলত্রুটিহীন আদর্শ খেলা, আমার কাছে সেটা বেরঙিন!'
আক্রমণের সময় ধৈর্য ধরে ওত পেতে বসে থাকা তালের ধাতে যেত না, তিনি নিজেই অ্যাটাকটা শুরু করতেন। তাল বলেন: 'যদি ভাগ্য সহায় হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকেন, তবে জীবন অনেক বিরক্তিকর হয়ে যায়।
স্যাক্রিফাইস বিষয়ে তার উক্তি আসলে জগতজোড়াই বিখ্যাত—'দাবায় শুধু দুরকমের স্যাক্রিফাইস বিদ্যমান—সঠিক ধরনের এবং আমারগুলো!'
এখন দেখার বিষয়, তালের এই দুর্দমনীয় কৌশল মিখাইল বটভিনিকের বিরুদ্ধে কি কার্যকর হয়েছিল?
লক্ষ্যটা যখন আকাশ ছোঁবার
তালের ১৯৫৭-৬০ সময়টা কেটেছে স্বপ্নের মতো। পরপর দুটি ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপ, তারপর ইন্টারজোনাল আর ক্যান্ডিডেটসও। বাকিদের স্তব্ধ করে দিয়ে একের পর এক ট্রফি নিজের ব্যাগে পুরে যাচ্ছিলেন দ্য ম্যাজিশিয়ান! ক্লাসিক্যাল দাবার ১৪তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভøাদিমির ক্রামনিক তালের সম্পর্কে এক ইন্টারভিউয়ে বলেন, 'তালের সম্পর্কে কিছু বলা কঠিন, কারণ তিনি ছিলেন খুবই অস্বাভাবিক (আন-ইউজুয়াল)। তাল ছিলেন এক ন্যাচারাল ফেনোমেনন, আর কোনো কিছুর সাথে তার তুলনা দেওয়া নিরর্থক! এমনকি তাল যদি দাবা না নিয়ে অন্য যেকোনো দিকে ফোকাস করতেন সেটিতেই সেরা হতেন। তাল বিজ্ঞানী হলে হয়তো বা নোবেল পেতেন!'
১৯৫৯ সালে যুগোস্লাভিয়ার ব্লেড-জাগ্রেব-বেলগ্রেডে আয়োজিত এই ক্যান্ডিডেটস ছিল দাবা ইতিহাসেরই সর্বকালের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক টুর্নামেন্ট। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোটে আটজন। যাদের অর্ধেকই ছিলেন তখনকার নিরিখে সাবেক বা পরবর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। প্রতিযোগীদের মধ্যে তাল ছাড়া ছিলেন পল কেরেস, তিগ্রান পেত্রশিয়ান, পল বেঙ্কো, ভাসিলি স্মিস্লভ, স্ভেতজার গ্লিগোরিচ, রবার্ট জেমস ফিশার (ববি ফিশার) এবং ফ্রেড্রিক ওলাফসন। সেসময়ের নিরিখে যাদের মধ্যে স্মিস্লভ ছিলেন সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর তাল, পেত্রশিয়ান ও ফিশার ভবিষ্যতের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
১৯৫৯ ক্যান্ডিডেটসে প্রতি খেলোয়াড় সবার সাথে চারটি করে ম্যাচ খেলেন এবং সব ম্যাচ শেষে পয়েন্ট তালিকা দাঁড়ায়—তাল (বিজয়ী), কেরেস (২য়) আর পেত্রশিয়ান (৩য়)। পয়েন্ট তালিকাতেও তাল পুরো দেড় পয়েন্টে এগিয়ে থেকে জয় ছিনিয়ে নেন—তাল (২০/২৮), আর কেরেস এবং পেত্রশিয়ান যথাক্রমে (১৮.৫/২৮) এবং (১৫.৫/২৮)। টুর্নামেন্টের বিজয়ী হিসেবে তাল বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ খেলার জন্য যোগ্যতা অর্জন করেন।
ইতিহাসের সৃষ্টি! সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!
তালের জীবনে এই ১৯৬০ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশজুড়ে ছিল। এই অর্জনের পরে ও নিজের আত্মজীবনী লেখার আগেও এই চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র বই লেখেন তাল। আত্মজীবনীতে তাল একটা গোটা অধ্যায়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে আলোচনা করেছেন। আর Tal-Botvinnik 1960 বইয়ে প্রতিটি ম্যাচ ধরে ধরে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তাল তার প্রস্তুতিকে তিনভাগে ভাগ করেন—দাবা বিষয়ক (মূলত ওপেনিং), সাইকোলজিক্যাল আর ফিজিক্যাল।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠদের কাতারে যাকে শুরুতেই দেখা হয়, সেই গ্যারি ক্যাসপারভ তালের ব্যাপারে বলেছেন: 'তাল সব ট্র্যাডিশনাল ধ্যান-ধারণার বাইরে দাবা খেলেছেন। কিন্তু সমস্যাটা এটা নয় যে, তিনি শুধু খেলেছেন। বরং তাল এভাবেই একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে জিতেও গেছেন!'
২১ গেমের ১৯৬৯ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ১ম গেমেই একটা জয় তুলে নেন তাল। এরপরের ৪টি গেম টানা ড্র হয় এবং ৬ষ্ঠ গেমে আবারও জয় পান তাল। এর দ্বারা প্রথম ৬ গেমেই ২ জয়ের এক বড়সড় লিড চলে আসে তাঁর কাছে। অপরদিকে বটভিনিকের ঘাড়ের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। কিন্তু বটভনিক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। সহজ প্রতিপক্ষ নন। এরপর তাল একটা গেম জেতার পর বটভিনিক আবার টানা দুই গেম জিতে ম্যাচে ফিরে আসেন! ৯ গেম শেষে স্কোরলাইন দাঁড়ায় এমন—তাল ৫, বটভিনিক ৪। কিন্তু প্রতিরোধ তার ওই পর্যন্তই, তাল আর বটভিনিককে আগে বাড়তে দেননি। এরপর তাল পুরো ম্যাচজুড়ে আর একটা গেমও হারেননি; উপরন্তু একাদশ, সপ্তদশ এবং ঊনবিংশ গেমে জিতে পুরো ম্যাচ বলতে গেলে নিজের করে নেন। বাকি সব ম্যাচ ড্র হয়।

উনিশতম গেম জেতার পর বাকি দুই গেম তালের শুধু ড্র করলেই চলত, এবং তিনি তা-ই করেছিলেন। সবশেষে পয়েন্ট দাঁড়ায়—তাল ১২.৫ এবং বটভিনিক ৮.৫। পুরো চার পয়েন্টের লিড নিয়ে তাল হয়ে যান সেসময়ের নিরিখে সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা অর্জন করেন মিখাইল তাল। গ্র্যান্ডমাস্টার রাগোজিন তার স্মরণে বলেন, 'তাল তো হাত দিয়ে ঘুঁটি নাড়াচাড়া করতেন না, তিনি যেন ব্যবহার করতেন এক জাদুর "ওয়ান্ড" (জাদুর লাঠি)!'
মুকুট হারানো এবং তারপর
তাল বেশিদিন আর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন থাকতে পারেননি। পরের বছরই রি-ম্যাচে বটভিনিক আবার পুনরুদ্ধার করেন নিজের মুকুট। তবে তাল এই স্বল্প সময়েই যা দিয়ে গেলেন বাকিরা হয়তো লম্বা সময় চ্যাম্পিয়ন থেকেও তা দাবাজগতকে দিয়ে যেতে পারতেন না!
ক্যারিয়ারের শেষেরদিকে এসে আবার স্বরূপে ফিরছিলেন তাল, ৭০-এর দশকে যখন তার স্বাস্থ্য প্রায় ভঙ্গুর, সেই ভগ্ন সময়েই। ৯৫ গেম অপরাজিত ছিলেন তিনি, রেকর্ড স্ট্রিক গড়েছিলেন! কিন্তু শেষতক আর চ্যাম্পিয়নশিপ পর্যন্ত আসতে পারেননি। ১৯৬৯ সালের ক্যান্ডিডেটস-এর সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়ে ভিক্টর করচনোইয়ের কাছে হেরে যান তাল। এভাবে আর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা হয়ে ওঠেনি তালের। এর বাইরে তালের বড় অর্জনের মধ্যে আছে ১৯৬৭ সালে তৃতীয় সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপ জয়।
নট ব্যাড ফর আ ডেড ম্যান
তালের ক্যারিয়ারজুড়েই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য অনেক ভুগিয়েছে তাকে। এর পেছনে তার লাগামছাড়া জীবনযাপনেরও দায় ছিল। একদিকে জন্ম থেকেই ভগ্নস্বাস্থ্য, তার ওপর বন্ধুবৎসল আর পার্টিপ্রিয় তাল ড্রিঙ্কিং বা স্মোকিংয়েও নিয়ন্ত্রণ রাখতেন না। তো একবার তিবিলিসি গিয়ে এক টুর্নামেন্টের মাঝপথে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় কিডনি অপসারণের জন্য। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, অপারেশন কক্ষেই মারা গেছেন তাল। যুগোস্লাভিয়ার পত্রপত্রিকায় সেই খবর ছাপা হলে তালের বন্ধুরা শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তাল তখন সশরীরে তাদের আশ্বাস দিতে যান এই বলে, 'আমার মৃত্যুর গুজবটা একটু বেশিই অতিরঞ্জিত ছিল! সেখানে তার টুর্নামেন্টটিও খেলেন তাল, এক ম্যাচে কুইন স্যাক্রিফাইস করলে ধারাভাষ্যকার হাস্যরস করে বলেন, 'not bad for a dead man, don't you think!'
টুর্নামেন্ট থেকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছিল অহরহ, অনেকসময় হাসপাতালে থেকেও দাবা খেলেছেন তাল। এমনকি মৃত্যুর এক মাস আগেও ব্লিটজ টুর্নামেন্ট খেলেছেন তিনি। প্রথম আয়োজিত ব্লিটজ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপেও চ্যাম্পিয়ন হন তাল। কিন্তু তার ভগ্নস্বাস্থ্য আর সায় দিচ্ছিল না। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ১৯৯২ সালের ২৭/২৮ জুন মস্কোর এক হাসপাতালে মারা যান তাল। একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানা যায় অন্ননালীর রক্তক্ষরণ।
তালের লেখার হাতও ছিল অসাধারণ। বই লিখেছেন প্রায় দশের অধিক, যার মধ্যে আত্মজীবনী The Life and Games of Mikhail Tal এবং বিশ্বজয়ের কাহিনি নিয়ে লেখা Tal–Botvinnik, 1960 সবথেকে বিখ্যাত। সমকালীন আরেক কিংবদন্তি রশিদ নাজমুদ্দিনোভের সাথে তালের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। রশিদও অনেক অ্যাটাকিং দাবা খেলতেন, ভাগ্যের ফেরে পড়ে গ্র্যান্ডমাস্টার হতে না পারা এই দাবাড়ুকে তাল অনেক সমীহ করতেন!