মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে ইইউ-তে মতবিরোধ, প্রভাব পড়তে পারে অর্থনীতিতে

বুচা শহরে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ইউক্রেনীয়দের ভয়ঙ্কর চিত্রের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিশ্বের ধনী গণতান্ত্রিক দেশগুলো। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে মিত্রদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ।
ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার জ্বালানি খাত নিয়ন্ত্রণে রাশিয়ান কয়লা আমদানি নিষিদ্ধ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এক্ষেত্রেও ঐক্য ধরে রাখতে পারে নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রুপ অফ সেভেনের মিত্ররা রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা সেবারব্যাংকসহ আরও কিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং রাশিয়ান সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে। এমনকি তাদেরকে মার্কিন ডলার-ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকেও বাদ দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি, আমেরিকানদের রাশিয়ায় নতুন বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া, মার্কিন ব্যাংকে অর্থ দেওয়ার মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে মস্কোকে বাধা দেওয়া হয়েছে নতুন নিষেধাজ্ঞায়।
এদিকে, রাশিয়ায় বেড়েছে রুবলের মূল্যমান। রুবলের মূল্যমান এখন প্রায় ১.২ সেন্ট, যা সংকটের আগে ১.৩ সেন্টের তুলনায় কিছুটা কম। তবে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই মুদ্রার মান নেমে গিয়েছিল ০.৮ সেন্ট বা এরচেয়েও নিচে; অন্তত সেই সময়ের তুলনায় এখন অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে রাশিয়ার মুদ্রা। যদিও মার্কিন ট্রেজারি কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া আশির দশকের বদ্ধ অর্থনীতিতে ফিরে যাচ্ছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়াকে জ্বালানি রপ্তানি থেকে রাজস্ব সংগ্রহ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে, এর মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ তারা ইউক্রেন আক্রমণে ব্যবহার করতে পারবে।
ইউএস ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন বুধবার মার্কিন আইন প্রণেতাদের বলেন, রাশিয়ান তেল ও গ্যাসের উপর নির্ভরশীল ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য রাশিয়ার জ্বালানির উপর শক্তিশালী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া এখনও সম্ভব নয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের প্রায় ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার হিসাবে এর মূল্য প্রতিদিন ৪০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের তেলের চাহিদার এক তৃতীয়াংশই পূরণ করে রাশিয়া। এর মূল্য দিনে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার।
নিউইয়র্কের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক অর্থনীতির পরিচালক বেন স্টিল বলেন, "আমরা এমন এক পর্যায়ে আছি যেখানে এই নিষেধাজ্ঞার জন্য আমাদেরও কিছুটা ভুগতে হবে।"
এদিকে, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে চলমান বিভেদ চলতি সপ্তাহে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অস্ট্রিয়ার অর্থমন্ত্রী ম্যাগনাস ব্রুনার রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে লুক্সেমবার্গে সাংবাদিকদের বলেন, এটি রাশিয়ার চেয়ে অস্ট্রিয়ার বেশি ক্ষতি করবে। অন্যদিকে, রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে লিথুয়ানিয়া।
ট্রেজারি অফিস অফ ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোলের প্রাক্তন কমপ্লায়েন্স অফিসার ড্যানিয়েল ট্যানেবাউম বলেন, "জ্বালানি ছাড়াও অন্যান্য শিল্পে রাশিয়ার বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।"
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে জোট যাতে বিপর্যস্ত না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ইউরোপীয় মিত্রদের জোর দিচ্ছে রাশিয়া। কিন্তু, এই ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ছে।
ইউরেশিয়া গ্রুপের পলিটিকাল রিস্ক পরামর্শদাতার ইউএস ডিরেক্টর ক্লেটন অ্যালেন বলেন, "এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।"
কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগে মার্কিন কর্মকর্তাদের ইউরোপীয় দেশগুলোকে কিছু আশ্বাস দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে জ্বালানির বাজার এবং সরবরাহ স্থিতিশীল করা যেতে পারে। "অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন কাউকেই সাহায্য করতে পারবে না," যোগ করেন অ্যালেন।
এদিকে, আসন্ন জি৭ বৈঠকে নিষেধাজ্ঞা জোরদারের বিষয়টি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তুলে ধরবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ইউএস ডেপুটি ট্রেজারি সেক্রেটারি ওয়ালি অ্যাডেইমো গত সপ্তাহে লন্ডন, ব্রাসেলস, প্যারিস এবং বার্লিনে অনুরূপ বৈঠক করেছেন।
নিষেধাজ্ঞার আলোচনায় জড়িত একজন ইউরোপীয় কূটনীতিকের মতে, রাশিয়ায় জার্মান এবং ফরাসি কোম্পানিগুলির ক্রমাগত লেনদেন, রাশিয়ান অলিগার্কদের বিলাসবহুল ইয়ট এবং অন্যান্য সম্পদের জন্য চলমান অনুসন্ধানসহ এখনও কিছু লুপহোল রয়ে গেছে।
- সূত্র- রয়টার্স