কী দেখে ওমিক্রন শনাক্ত করা যাবে ?

ব্রিটেনে করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভেরিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। তাদের কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। প্রতি দু'তিন দিনের ভেতর সংক্রমণের হার দ্বিগুণ হওয়ায় সে দেশের জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা করোনার পরবর্তী ঢেউয়ের ব্যাপারে সতর্কতা প্রকাশ করেছেন।
কোন টেস্টের সাহায্যে ওমিক্রন শনাক্ত করা হয়?
পলিমারেজ চেইন রিয়েকশন (পিসিআর) টেস্টের সোয়াব- যার সাহায্যে শ্লেষা, কফ, লালা প্রভৃতির সংগৃহীত নমুনা ল্যাবে বিশ্লেষণ মাধ্যমে করোনার ভেরিয়েন্টের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।
ব্রিটেনের সব ল্যাবে না থাকলেও, এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক ল্যাবগুলোয় ওমিক্রন শনাক্তের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি রয়েছে। সারা দেশজুড়ে থাকায় কোথাও কোথাও দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওমিক্রন শনাক্তকরণ সম্ভব।
কোনো সন্দেহভাজন নমুনা ওমিক্রন কিনা সেটি জানতে নমুনা ভাইরাসের পুরো জিন বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যে জন্য চার থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে। নাগরিকরা সংক্রমণের লক্ষণযুক্ত হলে সরকারি ওয়েবসাইটে অর্ডার করে বিনামূল্যে পিসিআর টেস্ট করাতে পারবেন। ভ্রমণগত কারণের ক্ষেত্রে বেসরকারিভাবে একটি পিসিআর টেস্ট ক্রয়ের বিধান রাখা হয়েছে।
সেলফ-আইসোলেশনের নিয়ম কি বদলেছে?
করোনার লক্ষণযুক্ত ও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সেলফ-আইসোলেশনের নিয়ম আগে যা ছিল, তাই-ই আছে। উভয়কেই ১০ দিন ঘরবন্দী থাকার মাধ্যমে আলাদা থাকতে হবে। তবে টিকাপ্রাপ্ত যারা কোভিড পজিটিভ ব্যক্তির সাথে মেলামেশা করেছে; তাদের সেলফ-আইসোলেশনের ব্যাপারে নিয়ম কিছুটা বদলেছে।
গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে ইংল্যান্ডে নিয়ম চালু হয়েছে যে, দুই ধাপে টিকাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি যদি করোনার যেকোনো ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত কারো সাথে ঘনিষ্ঠ হন তাহলে সঙ্গেসঙ্গেই আইসোলেটেড হওয়ার প্রয়োজন নেই। ওই ব্যক্তিকে সাত দিন টানা ফ্লো কোভিড টেস্টের ভেতর দিয়ে যেতে হবে।
কীভাবে ইংল্যান্ডে ওমিক্রন সংক্রমণের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল?
জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির সাহায্যে ওমিক্রন আক্রান্ত নমুনাগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে ওমিক্রনের ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞগণ নিশ্চিত হন।
তাদের মতানুসারে, ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ডেল্টার চেয়ে চারগুণ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সংক্রমণের হার এমন থাকলে আসছে বড়দিনের আগেই এটি বড় ধরনের সংক্রমণের ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে।
বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট টিকাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে বিপুলমাত্রায় তার অ্যান্টিবডিগুলোকে অসাড় করে দিতে পারে। টিকার ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি ভ্যাক্সিনেটেড ব্যক্তির শরীরে করোনার বিরুদ্ধে লড়ার মূলশক্তি। সেটিকে অসাড় করে দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ওমিক্রন তাই সকলের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, এটি টিকার কার্যকারিতা হ্রাসের সমান নয়।
বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, এখনও টিকা ওমিক্রন থেকে সৃষ্ট অনেক দুর্বলতা ও সমস্যাকে রুখে দিতে পারে। বুস্টার ডোজ বা তৃতীয় ডোজ ব্যক্তির শরীরে সর্বোচ্চ রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম।
বৃটেনে সম্প্রতি ১২ বছরের ঊর্ধ্বের ৮১ শতাংশ জনগণকে দুই ডোজ টিকার আওতায় আনা হয়েছে এবং তাদের মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশকে বুস্টার ডোজও প্রদান করা হয়েছে।
ল্যাটেরাল ফ্লো টেস্ট কি ওমিক্রন শনাক্ত করতে পারে?
র্যাপিড বা ল্যাটেরাল ফ্লো টেস্ট (এল এফ টি) যেটি বাড়িতে বসেই করা যায়- সেটির সাহায্যে ব্যক্তি করোনা পজিটিভ নাকি নেগেটিভ সেটি জানা গেলেও, করোনার ভেরিয়েন্ট জানা সম্ভব নয়।
এলএফটি টেস্টে কেউ পজিটিভ শনাক্ত হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে সেলফ-আইসোলেশনে যেতে হবে। তবে করোনার ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপারে জানতে চাইলে পিসিআর টেস্ট করাতেই হবে।
ওমিক্রন এবং অন্যান্য ভেরিয়েন্টের মধ্যে কী পার্থক্য রয়েছে?
ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ভেতর বিভিন্ন ধরনের মিউটেশন দেখা গেছে যা এর আগে দেখা যায়নি। ওমিক্রনের গায়ে বেশ কিছু সংখ্যক স্পাইক প্রোটিনের উপস্থিতি বিশেষজ্ঞদের চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ টিকার লক্ষ্য এ স্পাইক প্রোটিন। আর সেজন্যই ঝুঁকি বেশি।
একটি আদর্শ পিসিআর টেস্টে 'এস-জিন ড্রপআউট'-এর মাধ্যমে ওমিক্রনকে শনাক্ত করা হয়। করোনার ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের অধিকাংশ ভাইরাসে 'এস জিন'-এর অনুপস্থিতি প্রাথমিকভাবে ওমিক্রন শনাক্তকরনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, 'এস-জিন'-এর অনুপস্থিতি দেখেই নিশ্চিতভাবে একে ওমিক্রন আখ্যা দেওয়া যাবে না; সেক্ষেত্রে পুরো জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ধার করা জরুরি।
জিনোম সিকোয়েন্সিং কি ভূমিকা পালন করে?
ইংল্যান্ডে প্রতি সপ্তাহে করোনা পজিটিভ রেজাল্টের ২০ শতাংশ পর্যন্ত সোয়াব বা ৬০ হাজারের মতো কেসের নমুনা জিনোম সিকোয়েন্সিং এর জন্য পাঠানো হয়। জেনেটিক নমুনাগুলোকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বলতে পারেন, করোনা পজিটিভ কোনো ব্যক্তি কোন ভেরিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত। এ প্রক্রিয়ায় যে সোয়াবগুলোর নমুনা ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর ব্যাপারেই শুধু নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। এটি পুরো চিত্র দেয় না।
তবে, এ প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের একটি অনুপাত আন্দাজ করতে পারেন মাত্র। ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা ভেরিয়েন্ট শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে। তাই এসব অঞ্চলেই সবার আগে নতুন ভেরিয়েন্ট ধরা পড়ে। এর মানে এই নয় - এসব দেশেই সকল নতুন ভেরিয়েন্টের উদ্ভব হয়েছে।
ওমিক্রনের লক্ষণ কী?
অনেক আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় যারা ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছিলেন- তাদের অধিকাংশই ছিলেন তরুণ এবং মৃদু লক্ষণযুক্ত।
অনেকেই বলছেন যে, এটি ডেল্টা ভেরিয়েন্ট থেকে সামান্য আলাদা উপসর্গ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে ব্যথা-বেদনা ও স্বাদ-গন্ধ টিকে থাকার বিষয়টি উল্লেখ্য। কিন্তু এখনও সেটা পাকাপাকিভাবে বলা যাচ্ছে না।
দক্ষিণ আফ্রিকার হাসপাতালগুলোয় ওমিক্রন আক্রান্ত অনেককেই মারাত্মক অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই করোনা টিকা পাননি বা এক ডোজ পেয়েছেন। ওমিক্রনের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ মাত্রার সংক্রমণ বেড়ে গেলেও, টিকাপ্রাপ্তদের শরীরে পূর্ণাঙ্গ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবেই। আর সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
ইংল্যান্ডে দুই ডোজ তথা তিন ডোজ টিকা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে পরিচালিত হওয়ায় বিজ্ঞানীগণ আশা করছেন, সেখানে ওমিক্রনের ঢেউ মৃদুভাবে লাগবে এবং মৃত্যুহার হবে অনেককম।
- সূত্র: বিবিসি