ভারতে কোভিডের প্রাদুর্ভাব পুরো বিশ্বের জন্যই হুমকির কারণ

কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে সমগ্র বিশ্ব। একদিকে আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশসমূহ। ভ্যাকসিন গ্রহণের পর দীর্ঘসময়ের ব্যবধানে আপনজনদের জড়িয়ে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন এসব দেশের সৌভাগ্যবান মানুষগুলো। আর অন্যদিকে আছে দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশ ভারত। প্রিয়জনের লাশের পাশে শোকাগ্রস্ত পরিবারের আর্তনাদে বিদীর্ণ হয়ে ওঠছে এখানকার প্রকৃতি।
অক্সিজেন এবং শয্যা সংকটের কারণে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের। প্রায় প্রতিদিনই সংক্রমণ সংখ্যা নতুন রেকর্ড গড়ে চলেছে। ভারতের জাতীয় এই সংকট এখন পুরো বিশ্বজুড়েই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
সংক্রমণ যত বেশি ছড়াবে, ভাইরাসও তত বেশিবার অভিযোজিত হয়ে নতুন ধরন বা ভ্যারিয়্যান্ট সৃষ্টির মাধ্যমে বিদ্যমান ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতাকে চ্যালেঞ্জ করবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন ডাক্তার আশীষ ঝা বলেন, "ভারতকে সাহায্য না করলে, বিশ্বজুড়েই সংক্রমণ তীব্র রূপ ধারণ করতে পারে বলে আমার আশঙ্কা।"
আর এ কারণেই ভারতে কোভিডের প্রাদুর্ভাব পুরো বিশ্বের জন্যই হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতোমধ্যে বেশ কিছু দেশ চিকিৎসা সামগ্রী সংগ্রহের মাধ্যমে ভারতে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
এ সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে বায়ু থেকে কমপ্রেসের মাধ্যম অক্সিজেন উৎপাদনকারী অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র পাঠায়। বুধবার যুক্তরাজ্য, ইতালি এবং জার্মানি আরও কিছু চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এদিকে, রাশিয়ার বিমান ওষুধ, মনিটর এবং ভেন্টিলেটর নিয়ে দিল্লি অবতরণ করেছে।
বর্তমানে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবাদানের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তবে, সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচী বৃদ্ধিকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে ভারত সরকার। বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক হওয়া সত্ত্বেও ভারতের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন নেই। এমনকি দ্রুত ভ্যাকসিন উৎপাদন বৃদ্ধির মতো কোনো বিকল্প পথও এই মুহূর্তে দেখছে না ভারত।
এদিকে ভ্যাকসিন মজুদ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। বুধবার, ব্রিটিশ স্বাস্থ্য সচিব ম্যাট হ্যানকক জানান সাহায্য পাঠানোর মতো যুক্তরাজ্যের কাছে অতিরিক্ত ভ্যাকসিন নেই।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে আলোচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে ভ্যাকসিন পাঠাবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি। এ সপ্তাহের শুরুতে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে ছয় কোটি ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন দেওয়ার অঙ্গীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে, কখন কোন দেশকে তা পাঠানো হবে সে বিষয়ে খোলাসা করা হয়নি। হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, ভ্যাকসিনের এই সরবরাহে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক সংস্থা ইউএস ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিসেসের পরিচালক অ্যান্থনি ফাউচি বলেন, বিশ্বের সর্বত্র ভ্যাকসিনের বিতরণ সমানভাবে নিশ্চিত করা জরুরি।
দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "এই পরিস্থিতিতে আমরা একসাথে পড়েছি। পুরো পৃথিবী আন্তঃসংযোগে সংযুক্ত। এখানে প্রতিটি দেশের পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব আছে। বিশেষত, আপনি যদি ধনী দেশ হন এবং এমন দেশের সাথে আপনার সম্পর্ক থাকে যারা সম্পদ কিংবা সক্ষমতায় আপনার সমকক্ষ নয়, সেক্ষেত্রে দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়।"
ভারতের সংক্রমণ থামানো না গেলে তা প্রতিবেশী অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্বাস্থ্যকাঠামো ও সীমিত ভ্যাকসিন সরবরাহের দেশগুলোতে সংক্রমণ ছড়ানোর মাধ্যমে একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে আরে। বিশেষ করর নতুন এবং সম্ভাব্য অধিক সংক্রামক ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ রোধ করা না গেলে পরিণতি হবে ভয়াবহ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে ভারত অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ভারতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিশ্বব্যাপী টিকাদান কর্মসূচী হুমকির মুখে পড়বে।
কোনঠাসা নিম্ন আয়ের দেশ
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই ভ্যাকসিনের বাজারে নমনীয়তা সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে।
গত বছর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এক অধিবেশনে ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সংস্থাটির কাছে সাময়িকভাবে ভ্যাকসিনের স্বত্বাধিকার শিথিল করার প্রস্তাব রাখে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ভ্যাকসিন উৎপাদন ত্বরান্বিত করতেই এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।
বিশ্বের ৮০টি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এই প্রস্তাব সমর্থন করে। ল্যানসেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী সাময়িকভাবে স্বত্বাধিকার বাতিল করা হলে গুটিকয়েক প্যাটেন্টধারী ছাড়াও একাধিক প্রতিষ্ঠান দ্রুত ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করতে পারে।
তবে, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাধার মুখে এই প্রস্তাবনা বাতিল হয়। স্বত্বাধিকার তুলে নিলেই ভ্যাকসিন সরবরাহ হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাবে না বলে দাবি করে দেশগুলো।
মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের মাধ্যমে গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা হবে বলেও ব্যখ্যা করা হয়।
তবে, মেধাস্বত্ব নয় বরং সক্ষমতার অভাবকেই ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রধান বাধা বলে মনে করেন ব্রাউন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন ডক্টর ঝা।
"আমরা আজ থেকেই মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করলেও আজই ভ্যাকসিন সংখ্যা বাড়াতে পারব না। বিষয়টি প্রযুক্তিগত স্থানান্তর এবং ভ্যাকসিন উৎপাদন সম্পর্কৃত জ্ঞানের," বলেন তিনি। ডক্টর ঝায়ের মতে, ভারতের জন্য ভ্যাকসিন উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করাই এখন মূল সমস্যা।
সুতরাং, সমস্যা যা ছিল শেষ পর্যন্তও তাই থেকে যাচ্ছে। ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যতদিন না পর্যন্ত এই জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলা করতে পারছে, ততদিন ভ্যাকসিন সংকটও বিদ্যমান থাকবে। সেই সাথে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির সংকটকালও দীর্ঘায়িত হবে।
বৈশ্বিক মহামারিকে প্রতিহত করতে বিশ্বব্যাপী সমন্বিত সহযোগিতার প্রয়োজন।
"আমি মনে করি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশ্বের অন্যান্য অংশকে সাহায্য করা ধনী রাষ্ট্রসমূহ এবং আমাদের নৈতিক দায়িত্ব," বলেন ফাউচি।
- সূত্র: সিএনএন