কোভিড ও দুর্নীতিতে পূর্ব ভারতে হাতি-নিধন সংকটজনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে

কোভিড-১৯ লকডাউনের প্রভাবে পূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্যে হাতি হত্যার পরিমাণ সঙ্কটজনক মাত্রায় উন্নীত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মীরা। গত দুই বছরে ১৬০টি বিপন্ন বন্যহাতিকে নির্মুল করা হয়; এরমধ্যে গত পাঁচ মাসে শুধুমাত্র উড়িষ্যা রাজ্যেই হত্যা করা হয় ৪০টি হাতিকে।
ভয়েস ফর এশিয়ান এলিফেন্ট সোসাইটির (ভিএফএইএস) মতে, চাষাবাদের জন্য বনের জমি দখল করে নেওয়া মানুষের বিদ্যুৎ ও বিষের ফাঁদে বেশিরভাগ হাতি মারা গেছে। তারসঙ্গে, খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য বন উজাড়িকরণ ও মানুষের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে প্রাণীটির প্রাকৃতিক আবাস।
কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে কমেছে বনরক্ষীদের টহলের সংখ্যা। এই সুযোগে গজদন্তের লোভে হাতিদের হত্যার উৎসবে মেতেছে চোরা শিকারির দল।
তবে কোভিড মহামারির অযুহাত দিয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের টহলের দায়িত্ব পালন ও দুর্নীতি দমনে ইচ্ছেকৃত অবহেলা করছে বলে অভিযোগ ভিএফএইএস- এর।
এব্যাপারে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও জীববিজ্ঞানী সঙ্গীতা আইয়ার বলেন, "ভারত জুড়ে এক নীরব বিপর্যয় ঘটে চলেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উড়িষ্যার, সেখানে- দুর্নীতি, দায়িত্ব পালনে অনীহা এবং বন কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার অভাবে হাতিদের রক্ষা করা যাচ্ছে না।
হাতির মতো সংবেদনশীল ও সামাজিক একটি প্রাণীকে এভাবে নির্বিচারে হত্যার পেছনে রাজনীতিকদের ভূমিকা আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তার মতে, মন্ত্রীরা সঠিক তদন্তের উদ্যোগ নিলে এসব নির্মম মৃত্যু এড়ানো যেতো।
সঙ্গীতা জানান, দুর্নীতিবাজ অনেক কর্মকর্তার বাড়ি থেকে হাতির দাঁত উদ্ধার হয়েছে। এসব কর্মকর্তারা জানা আছে, হাতির দল কোথায় ঘুরে বেড়ায় এবং তারাই চোরা শিকারিদের খবর দিয়েছে।
"হাতিদের প্রতিবাদের ভাষা নেই। যাদের ওপর হাতিদের রক্ষার দায়িত্ব তারাই যদি বিশ্বাসভঙ্গ করে, তাহলে বোবা প্রাণীগুলো কথায় যাবে?" আক্ষেপের সুরে প্রশ্ন রাখেন সঙ্গীতা।
উড়িষ্যায় বনবিভাগের দুর্নীতি মহামারির আগে থেকেই বড় সমস্যা ছিল। ভারতের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত ৫ বছর উড়িষ্যার ৮২ জন বন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
কিন্তু, আশঙ্কার জায়গা অন্যত্র। পৃথিবীতে মাত্র ৪০ হাজার এশীয় হাতি অবশিষ্ট আছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিপন্ন ঘোষিত এ প্রাণীর ৬০ শতাংশ জনসংখ্যাই রয়েছে ভারতে। তাই সেখানে সংরক্ষণ কাজ প্রজাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত।
তবে সংরক্ষণ কর্মীরা বলছেন, দ্রুত বেড়ে চলা মানুষের জনসংখ্যা, খনি খনন ও কৃষিকাজে বিবেচনাহীন ভূমি ব্যবহার এবং হাতিদের আবাসস্থলের মধ্যে দিয়ে রেল ও সড়কপথ তৈরি করে প্রাণীটির সর্বনাশ করা হচ্ছে।
বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য পর্যবেক্ষণের দাতব্য সংস্থা ট্র্যাফিক- এর প্রতিবেদন অনুসারে, মহামারিকালে ভারতে বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী হত্যার পরিমাণ ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। আর ছোট স্তন্যপায়ী হত্যা বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
এখানেই শেষ নয়, ধারণা করা হচ্ছে আশঙ্কাজনক যে সংখ্যা সরকারি সূত্রে জানানো হচ্ছে তা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামবাসী হাতির মৃতদেহ খুঁজে পেলেও তা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানায় না।
২০১২ সালে 'অস্বাভাবিকভাবে মৃত' প্রতিটি হাতির মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করা হবে বলে ঘোষণা করেছিল উড়িষ্যার রাজ্য সরকার। তবে ঘোষণা শুধু কথাতেই রয়ে গেছে, অসাধু কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করতে মন্ত্রীরা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলে জানান সঙ্গীতা আইয়ার। একইসঙ্গে, তিনি সরকারের প্রতি একটি স্বচ্ছ তদন্ত শুরুর আহবান জানান।
"এশীয় হাতিরা বিলুপ্ত হলে বনের প্রাকৃতিক বাস্তসংস্থানে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হবে। এতে শুধু ভারত নয়, বরং প্রভাবিত হবে পুরো বিশ্ব। কারণ, হাতিরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনেও ভূমিকা রাখে। তাই হাতি নির্মূলের ঘটনাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই," যোগ করেন সঙ্গীতা।
এব্যাপারে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক অ্যাকশন ফর এলিফ্যান্টস-এর প্রতিষ্ঠাতা মারিয়া মসম্যান বলেন, "হাতিদের প্রতি এ ধরনের নির্দয় আচরণ ভারতের পঞ্চম বৃহৎ হাতি জনসংখ্যার জন্য পরিচিত উড়িষ্যার বৈশ্বিক মর্যাদাহানি করবে।"
এব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে উড়িষ্যা রাজ্য সরকারের সঙ্গেও যোগাযোগ করে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট। তবে সরকারি কর্মকর্তারা সেই অনুরোধে সাড়া দেননি।
- সূত্র: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট