দুই বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে ভর করে হাজার কোটির ইন্ডাস্ট্রি ইলেকট্রো মার্টের, গড়ছে লোকাল ব্র্যান্ডও

কনকা টিভি আমদানির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম সস্তায় রঙিন টিভি বাজারে এনেছিল ইলেকট্রো মার্ট। গ্রি ব্র্যান্ডের মাধ্যমে মানুষকে সহজলভ্য এসির অভিজ্ঞতাও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আমদানির মাধ্যমে দেশে ব্যবসা শুরু করলেও কনকা এবং গ্রি-এর মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের গায়ে এখন 'মেইড ইন বাংলাদেশ' ট্রেডমার্ক লাগিয়েছেন ইলেকট্রো মার্টের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ নুরুন নেওয়াজ সেলিম।
চীনের বিখ্যাত দুই ব্র্যান্ডের পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদনে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর পাশে সোনারগাঁওয়ে গড়েছেন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (টিআইআইএল) নামে ইলেকট্রনিক্স প্লান্ট। পাশাপাশি বিদেশি টেকনোলজি ব্যবহার করে দেশেও 'হাইকো' একটি লোকাল ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছেন তিনি। ২০৩০ সালের মধ্যে আরো ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অন্তত ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ইলেকট্রো মার্ট কাজ করছে বলে জানিয়েছেন এর কর্মকর্তারা।
ইলেকট্রো মার্ট লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর নুরুল আফসার বলেন, "বর্তমানে দেশে বিক্রি হওয়া এসির মধ্যে ৬০ শতাংশ গ্রি এর দখলে। টিভি ও ফ্রিজের মার্কেটে ২৫-৩০ শতাংশ করে কনকার দখলে। এর সম্পূর্ণটাই এখন বাংলাদেশে স্থাপিত ইলেকট্রো মার্টের কারখানায় 'মেইড ইন বাংলাদেশ' নামে উৎপাদিত। পাশাপাশি চীনের টেকনোলজিতে নির্মিত আমাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডও এরই মধ্যে ২-৩ শতাংশ বাজার দখল করেছে।"
নুরুল আফসার বলেন, "২০১৮ সালে সোনারগাঁওয়ে কারখানা স্থাপন করে প্রথমে কনকার সঙ্গে এবং গত বছর গ্রি-র সঙ্গে যৌথ প্রডাকশনে যাই আমরা। এ কারখানায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। কারখানায় সরাসরি কাজ করছে ২ হাজারের বেশি মানুষ।"

তিনি বলেন, "আমাদের নিজস্ব আরএনডি রয়েছে। বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে কোলাবরেশনে আমরা বাংলাদেশে প্রোডাক্ট ডেভেলপ করছি। আমাদের দেশের আবহাওয়া ও মানুষের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন প্রোডাক্ট মডেল বের করছি। তবে প্রোডাক্টের মানের ক্ষেত্রে ওদের বৈশ্বিক মান বজায় রাখছি।"
দেশের বাজারে বর্তমানে ইলেট্রো মার্টের সরাসরি আউটলেট রয়েছে ৫০টির বেশি। কোম্পানির অর্থায়ন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন যৌথ এক্সক্লুসিভ প্লাজা রয়েছে ১০০টির মতো। একইসঙ্গে ডিলারের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি।
দেশের বাজার দখলের পাশাপাশি নতুন কারখানায় উৎপাদিত টিভি, ফ্রিজ, এসি ছাড়াও মাইক্রোওয়েভ ওভেন, কুকার, ওয়াশিং মেশিন, ফ্যানসহ সব ধরণের হোম অ্যালায়েন্স রপ্তানির পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন নুরুল আফসার।
তিনি বলেন, "কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই এটি করা হবে। তার আগে ২০২৫ সালের মধ্যে রপ্তানি শুরু করবে ইলেকট্রো মার্ট।"
যেভাবে শুরু
১৯৮০ সালে বন্ধুর মাধ্যমে হংকংয়ের একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয়ের পর টিভি আমদানি করে তা দেশের বাজারে বিক্রি শুরু করেন ফেনীর মোহাম্মদ নুরুন নেওয়াজ সেলিম।
চট্টগ্রামে একটি ছোট অফিস নিয়ে হংকং থেকে আসা পণ্য দোকানে দোকানে পৌঁছে দিতেন। প্রথম দিকে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে ট্রেডিং শুরু করে এখন দুই হাজার কোটি টাকার কোম্পানি গড়েছেন নুরুন নেওয়াজ।
নুরুন নেওয়াজ বলেন, "স্বাধীনতার পর দেশে হাতে গোনা কিছু মানুষ টিভি, ফ্রিজ ব্যবহার করতেন। আশির দশকে হংকং, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে দেশে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিস্তার ঘটতে শুরু করে।"
১৯৮০ সালে নুরুন নেওয়াজ বিদেশ থেকে পণ্য এনে হোলসেল বিক্রি শুরু করেন। প্রথম দিকে সীমিত পরিসরেই চলেছে ব্যবসা। এরপর স্নাতক ডিগ্রী শেষ করে ১৯৯৮ সালে যোগ দেন ছোট ভাই নুরুল আফসার। তখন থেকে বাড়তে থাকে তাদের ব্যবসা।
নুরুল আফসার বলেন, "১৯৯৮ সালে মার্কেটে রঙিন টিভির দাম ছিল ৩০-৩৫ হাজার টাকা। ওই সময় আমরা দেশে চীনের কনকা রঙিন টিভি ১২ হাজার টাকায় বিক্রি শুরু করি। এটি তখন দেশে হইচই ফেলে দেয়।"
"আমরা ৫ বছরের ওয়ারেন্টি দিয়ে মার্কেটিং শুরু করেছি। অনেকেই বলতে শুরু করে যে, কালার থাকবে না, চোখের সমস্যা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। চার বছর পর ২০০২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আমাদের জন্য দারুণ সুযোগ নিয়ে আসে। ওই বছর কনকা টিভি কেনার জন্য মানুষের লাইন ধরে যায়। তখন সবাই দাম কমাতে বাধ্য হয়", যোগ করেন নুরুল আফসার।
তিনি বলেন, "টিভির সফলতার পর আমরা কনকার ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেনসহ অন্যান্য প্রডাক্ট আনা শুরু করি। এরই মধ্যে ২০০৪ সালের দিকে আমরা ছোট পরিসরে অ্যাসেম্বলিংও শুরু করি। তখন থেকেই কনকার পাশাপাশি গ্রি, ডাইকিন, তোশিবার পণ্যও দেশে আমদানি করে বিক্রি শুরু করি।"
নুরুল আফসার বলেন, "শুরুর দিকে আমরা জাপান, কোরিয়া, চীন থেকে এনে হোলসেল বিক্রি করতাম। হংকং থেকে ইলেকট্রনিক্স পণ্য এনে দেশের বাজারে খুচরা বিক্রেতাদের সরবরাহ করতাম। ওই সময় হংকং, সিঙ্গাপুর ও দুবাই থেকে সহজে আমদানি করা যেতো। চীন ও কোরিয়া এখনকার মতো এতো সহজগম্য ছিল না। রিটেইলারদের দিতে দিতে একসময় আমরাও শোরুম দিলাম। পরবর্তীতে অ্যাসেম্বলিংও করি। এখন ম্যানুফ্যাকচারিং।"

লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে রপ্তানি ও নিজস্ব ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা
নুরুল আফসার বলেন, "দেশে যত বেশি পণ্য উৎপাদন করা যাবে ততই আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারব। আমাদের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ছে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতাও। তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের ফলে মানুষ এখন জীবনযাপনে আধুনিকতার ছোঁয়া নিতে চাইছে। আমাদের এখন লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে রপ্তানি শুরু করা।
এ লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে ৫০ একর জমির ওপর অত্যাধুনিক কারখানায় আরো বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি হাইকো ব্র্যান্ডকে পরিচিত করতে এ ব্র্যান্ডের অধীনে সব ধরণের পণ্য উৎপাদন করছি। সারাদেশে কনকা ও গ্রি এর ডিলাররা হাইকোর পণ্য বিক্রি করছে।"
কনকা ব্র্যান্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, চীনের এ ব্র্যান্ড প্রায় ১৪০টি দেশের বাজারে রয়েছে। আমাদের দেশেও কনকা অনেক জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড। অন্যদিকে, বিশ্বের প্রায় ১৫০টিরও বেশি দেশে গ্রি এসি রপ্তানি হয়।