রেলপথে রপ্তানির সুযোগ খুঁজছে ঢাকা

মহামারিকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কন্টেইনার ট্রেইন সার্ভিস জোরদার হতে শুরু করে, যা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সরকার বর্তমানে অন্য দুই প্রতিবেশী দেশ ভুটান ও নেপালের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে চাঙ্গা করতে ক্রস-বর্ডার রেলপথ সংযোগকে নতুন করে চালুর পথ খুঁজছে।
এরই অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান ৯টি রেলওয়ে ইন্টারচেঞ্জের বর্তমান পরিস্থিতি কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের মাধ্যমে একটি প্রতিবেদন সংগ্রহ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বর্তমান চালু পাঁচটি ইন্টারচেঞ্জের মধ্যে চারটি রুটে নিয়মিত ভারত থেকে পণ্য আমদানি হলেও রপ্তানি হচ্ছে না কোন পণ্য।
ডেপুটি হাইকমিশন বলা হয়েছে, ভারত থেকে আসা ফ্রেইট ট্রেনগুলো খালি ফিরে যাচ্ছে। এসব ইন্টারচেঞ্জের বাংলাদেশ অংশে কাস্টমস কন্ট্রোলসহ স্টোরেজ ইয়ার্ড নির্মাণ করা হলে আমদানির পাশাপাশি রেলরুটে ভারতে রপ্তানি করতে পারবে বাংলাদেশ। এছাড়া, ইন্টারচেঞ্জগুলো ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করে শক্তিশালী ট্রানজিট ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
যমুনা সেতুর উপর নির্মিতব্য নতুন রেল সেতু নির্মাণ হলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ভারতে সরাসরি ফ্রেইট ট্রেন চলাচল করতে পারবে, তখন রেলপথে আমদানি-রপ্তানি আরও বাড়বে বলে আশা করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৯টি ইন্টারচেঞ্জ ছিল, যার মধ্যে দর্শনা-গেদে, বেনাপোল-পেট্রাপোল, চিলাহাটি-হলদিবাড়ি ও বিরল-রাধিকাপুর চালু রয়েছে। এর মধ্যে দর্শনা-গেদে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে (টিএআর) রুট-১, রোহনপুর-সিংগাবাদ টিএআর-২ রুট হিসেবে চিহ্নিত।
ভারতীয় ঋণে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ সংযোগ নির্মাণ কাজ চলছে। পঞ্চগড়-সিলিগুড়ি রেল সংযোগ স্থাপনে উভয় দেশ সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাবনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে।
এছাড়া বুড়িমারী-চেংরাবান্ধা, মোগলহাট-গিতালদহ এবং ফেনি-বেলোনিয়া রেল ইন্টারচেঞ্জ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে দুই দেশের।
রেলপথে আমদানি বাড়ছে, রপ্তানির খাতা এখনো শূন্য
যদিও ভারত থেকে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পণ্য আমদানি হয় মূলত ট্রাকের মাধ্যমে, মহামারির ভেতর রেলপথে পণ্য আমদানিও বাড়তে থাকে।
এই মুহূর্তে চলমান পাঁচটি রুটের মধ্যে দর্শনা পয়েন্টের রেল ফ্রেইট দিয়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। এর পরেই রয়েছে বেনাপোল।
গত ৬ ডিসেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে ডেপুটি হাইকমিশন বলেছে, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা-গেদে ও বেনাপোল-পেট্রাপোল ইন্টারচেঞ্জ দিয়ে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৫৩ লাখ টন ভারতীয় পণ্য আমদানি হয়েছে। এছাড়া রোহনপুর-সিংগাবাদ ও বিরল-রাধিকাপুর ইন্টারচেঞ্জ দিয়ে প্রতিদিন ভারত থেকে ১.৫ রেক পণ্য আমদানি হচ্ছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বেনাপোল রেলরুটে ভারত থেকে আমদানি হয়েছিল ১.৮৪ লাখ টন পণ্য, করোনা সংক্রমণ বাড়ায় পরের অর্থবছর আমদানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৪০ লাখ টন।
অথচ ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেলেও, বাংলাদেশে আসা কন্টেইনারগুলো খালি অবস্থাতেই ফিরে যাচ্ছে। ট্রেড ফ্যাসিলিটেটর ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এর পেছনে দায়ী করছেন আমদানিযোগ্য পণ্যের অভাবকে।
চুয়াডাঙ্গা দর্শনা আন্তর্জাতিক রেল স্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট মীর মোঃ লিয়াকত হোসেন জানান, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলপথ দিয়ে মালবাহী ওয়্যাগনে করে পাথর, গম, ভুট্টা, চাল ভারত থেকে নিয়মিত বাংলাদেশে আসে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে রেলপথ দিয়ে মালবাহী ওয়্যাগনে করে ভারতে যাওয়ার মতো কোনো পণ্য না থাকায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখান না বলে তিনি জানান।
দর্শনা শুল্ক স্টেশন চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে রাজস্ব আয় করেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। পণ্য আমদানি করোনাকালের চেয়ে বেশি হওয়ায় রাজস্ব আয় বাড়তে শুরু করেছে। ভারত থেকে রেকর্ড পরিমাণ, ১৩ হাজার ৬৬৯টি ওয়্যাগনে করে বাংলাদেশে পণ্য আসে। পাথর, ছাই, ভুষি, চাল, গম, ভুট্টা, মাছের খাবারসহ বিভিন্ন পণ্য আসে। রেলওয়ের আয় হয়েছে ৩৫ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৬৯২ টাকা।
সরকারের লক্ষ্য রপ্তানির সুযোগ বাড়ানো
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে রেলপথে পণ্য রপ্তানির সুযোগ বাড়ানো সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। কম খরচে পণ্যের নিরাপত্তাসহ রেলে রপ্তানির সুযোগ উভয় দেশই কাজে লাগাতে আগ্রহী। এছাড়া, ট্রান্স-এশিয়ান রেলরুট স্থাপনের ক্ষেত্রে বন্ধ রুটগুলো চালু করা দরকার।
আগামী জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠেয় বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকে রেলে আমদানি-রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হবে। তবে ফ্রেইট ট্রেন চালুর বিষয়ে সবকিছু চূড়ান্ত করবে রেল মন্ত্রণালয়। গত মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সচিব সভায় দর্শনা-গেদে রেলরুটে পণ্য রপ্তানির প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ডেপুটি হাইকমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী চালু থাকা ইন্টারচেঞ্জগুলোতে স্টোরেজ ইয়ার্ড নির্মাণে রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখবে তারা।
তিনি জানান, দর্শনা- গেদে রেলরুট ব্যবহার করে ভারতে পণ্য রপ্তানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিন বছর আগে থেকেই পরিকল্পনা করে আসছিল। এ বন্দর দিয়ে রপ্তানি করতে কি কি অবকাঠামো প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করতে ২০১৮ সালে একটি কমিটি গঠন করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কমিটি কাস্টমস কন্ট্রোলসহ স্টোরেজ ইয়ার্ড নির্মাণে রেল মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রেলরুট ব্যবহার করে পণ্য আমদানির পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধি এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি ওইসব রুট ব্যবহার করে কিভাবে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে, সে প্রচেষ্টাও রয়েছে সরকারের।
ভারতের চালু থাকা ইন্টারচেঞ্জগুলোর মাধ্যমে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাড়াতে স্টোরেজ ইয়ার্ড নির্মাণসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে রেল মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ জানতে চাইলে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।
ব্যবসায়ীদের পছন্দ রেলপথ
২০২০ সালের জুলাই মাসে, প্রথম ট্রায়াল রানের দুই বছরেরও বেশি সময় পর, বাংলাদেশ ও ভারত একটি নতুন কার্গো ট্রেন রুট চালু করে।
একটি কন্টেইনার ট্রেনের কলকাতা থেকে বেনাপোল পৌঁছাতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা, যেখানে একটি ট্রাককে সীমান্ত পার হতে অপেক্ষা করতে হয় ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময়।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও ট্রাকে আমদানি-রপ্তানির পরিবর্তে রেলপথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আগ্রহী। বর্তমানে শুধু বেনাপোল-পেট্রাপোল দিয়ে সুতা আমদানি করতে পারেন নিটওয়্যার রপ্তানিকারকরা। তারা দর্শনাসহ অন্য ইন্টারচেঞ্জগুলো দিয়েও আমদানি সুবিধা চেয়ে এনবিআরে চিঠি লিখেছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. হাতেম।
তিনি বলেন, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন পণ্য ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে গার্মেন্ট পণ্য শুধু বেনাপোল দিয়েই রেলপথে ভারতে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। আমরা রপ্তানির ক্ষেত্রেও অন্যান্য রেলরুট চালু করতে এনবিআরের সঙ্গে সভা করেছি। রেলপথে রপ্তানি করতে পারলে রপ্তানি ব্যয় কমবে, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে।
বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রপ্তানি সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক জানান, একসময় মালবাহী ওয়্যাগনে করে চিটাগুড় ভারতে যেত বাংলাদেশ থেকে। ২০১০ সালে সর্বশেষ চিটাগুড় রপ্তানি হয় ভারতে। এরপর থেকে আর কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি।
বেনাপোল সি অ্যান্ড এফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সুজন জানান, দীর্ঘ দুই বছর ধরে অবৈধ ভারতীয় ট্রাক পার্কিং সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি থাকা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা অবশেষে মুক্তি পেতে শুরু করেছেন। এখন তারা সব ধরনের পণ্যই রেলপথে আমদানি করছেন। এখন যদি রপ্তানিও এভাবেই শুরু করা যায়, তাহলে তারা লাভবান হবেন।
বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মোঃ আজিজুর রহমান বলেন, কন্টেইনার ট্রেনের মাধ্যমে ভারতে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বিস্তারের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এর ফলে সময় বাঁচছে, খরচ কমছে, নিরাপত্তাও বাড়ছে।
তিনি বলেন, "যদি স্থলপথের পাশাপাশি রেলপথেও ভারত থেকে পণ্য আসে, তাহলে দেশের রেলব্যবস্থারও উন্নতি ঘটবে। আমরা রেলপথে ভারতে পণ্য রপ্তানির কথাও ভাবছি।"
(এই প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেছেন আমাদের চুয়াডাঙ্গা ও যশোর প্রতিনিধি)