কলমানি বাজারকে প্রাণবন্ত করতে ২৮ ও ১৪ দিন মেয়াদি রেপো সুবিধা বন্ধ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

এক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের ধার নেওয়ার প্লাটফর্ম আন্তঃব্যাংক কলমানি বাজারকে আরও প্রাণবন্ত করতে ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নির্ভরতা কমাতে ১৪ দিন ও ২৮ দিন মেয়াদি রেপো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চালু থাকবে শুধু ৭ দিন মেয়াদি রেপো সুবিধা।
একইসঙ্গে রেপোর মাধ্যমে অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে এখন থেকে কোনো বাড়তি চার্জ নেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
গতকাল সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) এক নীতিনির্ধারণী বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সভায় উপস্থিত একাধিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বর্তমানে ২৮ দিন মেয়াদি রেপো নেওয়া হচ্ছে বেশি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, সুদহার করিডরের আওতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিচালিত খোলাবাজার কার্যক্রম বা ওপেন মার্কেট অপারেশন আরও বেশি কার্যকর করার লক্ষ্যে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
রেপো বা পুনঃক্রয় চুক্তি হলো এক ধরনের স্বল্পমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থা, যা মূলত সরকারি সিকিউরিটিজে নেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নির্দিষ্ট মূল্যে সিকিউরিটি বিক্রিজ করে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পরে সামান্য বেশি দামে তা ফের কিনে নেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ৭, ১৩ ও ২৮ দিন মেয়াদি রেপো নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। তবে আগামী মার্চ বা এপ্রিলে ২৮ দিন এবং জুনের প্রথম সপ্তাহ বা মাঝামাঝি থেকে ১৪ দিন মেয়াদি রেপো বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে আগামী কয়েক মাস পর থেকে ব্যাংকগুলো শুধু ৭ দিন মেয়াদি রেপো সুবিধা নিতে পারবে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য আগে প্রতিদিন রেপোর মাধ্যমে ধার নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে এই সুবিধা বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, এখন থেকে প্রতি সপ্তাহের সোম ও বুধবার রেপো সুবিধার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া হবে। পরে নভেম্বর থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য রেপোর মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে টাকা ধার করার সুযোগ আরও কমিয়ে সপ্তাহে একদিন করা হয়। এবার সেই সুযোগ আরো সংকুচিত হতে চলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক নীতি নির্ধারণী কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের ঋণ পেতে কিছু শর্ত মানতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম একটি শর্ত ছিল রেপোর টুলগুলো কমিয়ে আনা। 'বর্তমানে আমরা দেখছি, অনেক ব্যাংক কলমানি মার্কেট থেকে টাকা ধার না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করছে। এতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর অতিনির্ভরতার কারণে ব্যাংকগুলোর নিজেদের সক্ষমতা গড়ে উঠছে না,' ওই কর্মকর্তা বলেন।
এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭ দিন মেয়াদি রেপো ছাড়া অন্য দুই মেয়াদি রেপো বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে বলে জানান তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'আমরা দেখছি, অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১৪ ও ২৮ দিন মেয়াদি রেপোর মাধ্যমে কম সুদে টাকা ধার নিয়ে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে উচ্চসুদে বিনিয়োগ করে বাড়তি আয় করছে। আমরা এই সুযোগটাও বন্ধ করতে চাচ্ছি।'
তবে দৈনিক ভিত্তিতে প্রচলিত স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলআর) ও স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুবিধা অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো প্রতিদিনই এসএলআরের মাধ্যমে ইচ্ছামতো টাকা ধার করতে পারে।
'এছাড়া কোনো ব্যাংক যত রেপো ডিমান্ড করছে, তার শতভাগই তাদের দেওয়া হচ্ছে। ফলে তারল্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এছাড়া রেপো নেওয়ার ক্ষেত্রে আগে মেয়াদভেদে ২০ থেকে ৪০ বেসিস পয়েন্ট অতিরিক্ত চার্জ নেওয়া হতো। এখন থেকে সেটি আর নেওয়া হবে না। ফলে ব্যাংকগুলোর খরচ কমবে,' বলেন তিনি।
সভায় উপস্থিত একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'আমরা সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আমাদের সমস্যাগুলোর কথা জানিয়েছি। প্রথমত, এখন যে পরিমাণ রেপো আউটস্ট্যান্ডিং রয়েছে, সেটি কমিয়ে দিলে অনেক ব্যাংকের সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য তারল্য ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হবে। এছাড়া আমরা সব ব্যাংককে টাকা ধার দেব না। কারণ অনেক ব্যাংকের ধারের টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা নেই। ফলে আমরা ডিপোজিটরদের টাকা ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখেশুনেই ব্যাংক বাছাই করব।'
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে ইন্ট্রা-ডে রেপো চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে উল্লেখ করে এই অভিজ্ঞ ব্যাংকার বলেন, 'আমরা এখন কোনো মেয়াদে রেপো নিলে সেটা মেয়াদপূর্তির দিন সকালেই আমাদের অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া হয়। অন্যদিকে, নতুন রেপোর টাকা আমাদের অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট হয় বিকেলের দিকে। ফলে দিনভর আমাদের তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে সমস্যায় পড়তে হয়। এজন্য আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইন্ট্রা-ডে রেপো চালু করার আবেদন করেছি, যাতে ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হয়।'
ব্যাংকগুলোর ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা কিছুটা শিথিল করার সম্ভাবনা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের ৪ শতাংশ সিআরআর হিসেবে রাখতে হয়। তবে কোনো কোনো দিনে এটি ৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে আনার অনুমতি দেওয়া হতে পারে। তবে ১৪ দিনের গড় হার ৪ শতাংশ বজায় রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, তারল্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দৈনিক ন্যূনতম সিআরআর সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতায় কিছুটা ছাড় দেওয়া হতে পারে। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।