প্রযুক্তি যাদের সাধ্যের বাইরে, তাদের বাদ দিয়ে অনলাইন শিক্ষা কাজে আসবে না

মহামারি পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং প্রভাব নিয়ে সম্পাদকীয়টি প্রকাশ করেছে বিখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার ডটকম। শিক্ষাখাতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে অনলাইন শিক্ষার বিশ্লেষণ সেখানে প্রাধান্য পায়। যার ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো;
শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন যোগ করেছে কোভিড-১৯। বিদ্যালয়ে গিয়ে সরাসরি পাঠগ্রহণের বদলে তথ্যপ্রযুক্তি'র সুবিধা নিয়ে অনলাইন শ্রেণিকক্ষে প্রতিদিন অংশ নিচ্ছেন লাখো শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষা সহযোগী কর্মী। শতবর্ষ প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থায় এ যেন নতুন এক বিপ্লব।
বিশ্বের অনেকস্থানেই এখন স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা নতুন মাত্রা পেয়েছে ল্যাপটপ আর স্মার্টফোনের পর্দায়। কিছু দেশে আবার ইন্টারনেট প্রতিস্থাপন করেছে আসল পাঠ্যপুস্তক।
সবকিছুই হয়েছে অবিশ্বাস্য গতিতে, অবিশ্বাস্য চমকের মতো। স্কুলগামী ছোট শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া পূর্ণবয়স্ক তরুণ কেউই যার প্রভাবমুক্ত থাকেনি।
শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ওপর এ পরিণতির পূর্ণ প্রভাব এবং ত্রুটি নিয়ে এখনও গবেষণা করছেন শিক্ষাবিদ এবং প্রযুক্তি বিশারদেরা। চাইছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরও শিক্ষা উপযোগী প্রযুক্তি প্লাটফর্ম তৈরি ও সরবরাহ করতে।
বিকল্প পদ্ধতি অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাখাতে রয়েছে। মহামারির অনেক আগে থেকেই বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয় এর আওতায় শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত গণকোর্স ভিত্তিক শ্রেণি পাঠদান বা এমওওসি কোর্সে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। নানা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার শিক্ষার্থীদের জন্য সরাসরি পাঠদানের বিকল্প এ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
মহামারিতে এখন সেই বিকল্প ব্যবস্থাই বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠেছে। যদিও, পাশাপাশি এ পরিবর্তিত ব্যবস্থার প্রভাবগুলির আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি।
যে বিষয়টা ইতোমধ্যেই আমরা জানি তা হচ্ছে; এখানে বিস্তর বৈষম্য ও ত্রুটির ক্ষেত্র রয়েছে। বৈপ্লবিক পরিবর্তনটির জন্যও যা বড় হুমকি।
মহামারি পূর্ব বিশ্বে ২০৩০ সাল নাগাদ; সকল শিশুর জন্য নূন্যতম প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার দিকে ভালোই অগ্রসর হয়েছিল অনেক উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ। এই প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে; ক্ষুদে বিদ্যার্থীদের স্কুল পূর্ববর্তী শিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষার মধ্যে সংযোগ সেতু। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহের মধ্যে এটি অর্জনের সম্ভাবনাই সবচেয়ে জোরালোভাবে দেখা যাচ্ছিল।
কিন্তু, কোভিড-১৯ পাল্টে দিয়েছে সেসব সমীকরণ। আদতে দেখা যাচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এ অর্জন না হওয়ার ঝুঁকিটাই বেশ। এ গুরুতর প্রভাব আমাদের সকলের জন্যেই চিন্তার কারণ হওয়া উচিৎ। কারণ, সবার মাঝে ন্যায্যভাবে শিক্ষার আলোর সম্প্রসারণ না হলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং বিকাশের চিন্তাও করা যাবে না। বরং দিনশেষে বৈষম্যের পাল্লাই ভারি হবে।
জাতিসংঘের বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা সংস্থা- ইউনেস্কো জানাচ্ছে, চলতি সপ্তাহ নাগাদ কোভিড-১৯ এর কারণে স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থাকা সত্ত্বেও- বিশ্বব্যাপী ৮৫ কোটি শিক্ষার্থী এখন শিক্ষা বা কর্মমুখী প্রশিক্ষণের সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে।
বিশ্বের অনেক দেশে ইতোমধ্যেই স্কুলে পাঠদান শুরু হলেও, তার অধিকাংশই হয়েছে উন্নত বিশ্বে। এখনও বিদ্যালয় বন্ধ প্রায় ৫২টি দেশে। এ অবস্থায় ইউনেস্কো মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের দৈনিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এ তথ্য জানায়।
সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলো। সোজা কথায়; শিক্ষা পদ্ধতির যে অনলাইন বিল্পব চলছে- তাতে অংশ নিতে পারছে না এসব দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী।
বিশ্বের এ অংশে এমনিতেই ইন্টারনেট সংযোগ ঘনত্ব কম। আন্তর্জাতিক টেলিকম্যিউনিকেশন ইউনিয়নের মতে, কমপক্ষে ৩৬ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে এ সংযোগ সুবিধার বাইরে। অনেক উন্নয়নশীল দেশে যেকারণে ব্রডব্যান্ডের পাশাপাশি, টেলিভিশন এবং রেডিও সম্প্রচারের সাহায্যে বিকল্প পাঠদান চলছে। এটি সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ও করছে। তবে জাতীয় পর্যায়ের এমন উদ্যোগের বাইরে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন পাঠদানের আওতা বাড়েনি।
প্রাণঘাতী জীবাণুর সংক্রমণ এখনও চলমান, তাই চাইলেও বিশ্বের অনেক দরিদ্রতম দেশ বা অঞ্চলে; যেখানে আগে থেকেই বৈষম্য বেশি- সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় খুলে দেওয়াও সম্ভব নয়। খোদ উচ্চ আয়ের দেশগুলোই তাদের বৈষম্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর বসবাস বেশি এমন এলাকায় শিক্ষাকেন্দ্র খুলতে গিয়ে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।
অতিরিক্ত জনসমাগম মানেই, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সেখানে সম্ভব নয়। করোনাভাইরাস এখন বাতাসে ভর করেও ছড়াচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা বাড়াতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের যথেষ্ট অভাব আছে।
সোজা কথায়,উন্নত হোক বা অনুন্নত দেশ; দরিদ্রতম পরিবারের ইন্টারনেট সংযোগবিহীন ছাত্ররা শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হবে। দিনদিন যা আরও বাড়িয়ে দেবে ইতোমধ্যেই বিদ্যমান শিক্ষা বৈষম্যকে।
জ্ঞানার্জন যেহেতু পরবর্তীতে চাকরি, আয় এবং স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে; তাই বলা যায় শিক্ষার বঞ্চণা সারাজীবন ধরে ভোগ করতে হবে অগণিত প্রজন্মকে। এই বঞ্চণা নিরসন ব্যতীত কোনো উপায় নেই। তাছাড়া, বাজারে টিকা আসলেও উন্নয়নশীল দেশের সব মানুষকে তা দিতে অনেক বছর লেগে যাবে, এমন অনুমান করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তাই মহামারি পরিস্থিতিতে কীভাবে সার্বজনীন শিক্ষা প্রযুক্তির উন্মেষ ঘটানো যায়, তা নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে বিশেষজ্ঞদের।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একটি উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিছু দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফ্রি অনলাইন সম্প্রচারের মাধ্যমে পিছিয়ে থাকা এলাকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে, মহামারির কারণে বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ঘিরে। তারা যদি এখন শিক্ষিত না হওয়ারই সুযোগ না পায়, তাহলে উচ্চশিক্ষার পাঠগ্রহণই বা পরবর্তীতে কীভাবে করবে?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে আরও অনেকদিন, বাস্তবতা এটাই। অনলাইন শিক্ষাই থাকবে প্রকৃত বিকল্প হিসেবে। আর ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এবং ব্রডব্যান্ড সংযোগ যদি সরাসরি শিক্ষক, পাঠাগার এবং গবেষণাগারের বিকল্প হয়; তাহলে বর্তমান ব্যবস্থায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী তার কোনো সুবিধাই গ্রহণ করতে পারবে না। বিশেষত- তারা; যাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ অর্থনৈতিক মন্দায় দারুণ সংকটে।
সবকিছু মিলিয়ে এমুহূর্তে শিক্ষার প্রসারে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দে ইন্টারনেট সংযোগ এবং প্রযুক্তি উপকরণ সরবরাহের কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং এনজিও'গুলোকে এখন থেকেই এব্যাপারে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং প্রকল্প তৈরির পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
মেধার উন্মেষ ঘটিয়ে উদ্ভাবনী জনশক্তি তৈরির যে সুফল আগামী কয়েক দশকে পাওয়া যাবে - তার বিপরীতে এটি খুবই কম মূল্য পরিশোধ, বলেই তারা অভিমত দিয়েছেন।
- সূত্র: নেচার ডটকম
- অনুবাদ : নূর মাজিদ