উল্কাপিণ্ড বিক্রি করে কোটিপতি হওয়ার দুরাশা

গত আগস্টে ইন্দোনেশিয়ার একটি গ্রামে এক যুবকের বাড়ির ছাদে উল্কাপিণ্ড পড়ার ঘটনায় হৈচৈ পড়ে যায়। ধারণা করা হয়েছিল, ওই উল্কাপিণ্ডের কারণে রাতারাতি কোটিপতি হতে চলে চলেছেন তিনি।
উল্কাপিণ্ডটির দাম প্রায় ১৮ লাখ ডলার, এমন তথ্যও প্রকাশিত হয় অনেক সংবাদ মাধ্যমে। মার্কিন সংগ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে তিনি ঠকে যেতে পারেন, এমন বিতর্কও শুরু হয়। তবে এর কোনোটিই সত্য নয়।
ঘটনার সূত্রপাত
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার একটি গ্রামের অধিবাসী জশুয়া হুতাগালাঙ্ক। গত আগস্টের এক রাতে হঠাৎ তিনি তার ছাদের ওপর বিকট শব্দ শুনতে পান। তার বাড়ির ছাদের টিন ফুটো করে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ে উল্কাপিণ্ডটি, ঘরের মেঝেতে প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত তৈরি হয়। ঘরের মেঝে খুঁড়ে ২ কেজি ওজনের পাথরটি বের করেন তিনি।
জশুয়া উল্কাপিণ্ডের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন, তারপরই রাতারাতি ইন্দোনেশিয়া ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে পৌঁছে যায় এ খবর।
মহাবিশ্বে ভ্রমণরত এই মহাজাগতিক বস্তুগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলে বাতাসের সংস্পর্শে জ্বলে ওঠে, তখনই উল্কাপাত হয়। পৃথিবীতে পতিত হওয়া অনেক উল্কাপিণ্ডের বয়সই পৃথিবীর চেয়েও অনেক বেশি।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে অনেক অজানা অনেক তথ্য দিতে পারে উল্কাপিণ্ড। একারণেই উল্কাপিণ্ড নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের শেষ নেই।
শুধু বিজ্ঞানের জগতেই নয়, প্রাচীন মহাজাগতিক বস্তু হওয়ায় এর সংগ্রাহক মূল্যও অনেক।

এ ধরনের সংগ্রাহকরাই জশুয়ার খুঁজে পাওয়া উল্কাপিণ্ড কিনে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে আগস্টে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অন্যান্য অনেক দেশের মতো ইন্দোনেশিয়ার বৈদেশিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। তখনই মার্কিন এক সংগ্রাহক ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থানকারী আরেকজন মার্কিন নাগরিকের সাহায্যে উল্কাপিণ্ডটি কিনে নেন।
উল্কাপিণ্ডটি ঠিক কত দামে বিক্রি হয়েছে তা প্রকাশ করেননি কোনো পক্ষই। তবে তাদের নির্ধারিত দাম গণমাধ্যমগুলোর অনুমিত দামের ধারে-কাছেও ছিল না।
দামের বিভ্রান্তি
এক্ষেত্রে প্রশ্ন চলে আসে, কীভাবে ১৮ লাখ ডলার দামের কথা চাউর হলো? মূলত অতি উৎসাহী বিক্রেতা এবং অন্যান্য অনেকের অপরিপক্ক হিসাব থেকেই এই দামের ধারণা করা হয়।
২ কেজির বড় উল্কাপিণ্ডটি ছাড়াও জশুয়ার বাড়ির আশেপাশে আরও বেশ কয়েকটি ছোট উল্কাপিণ্ড পাওয়া যায়। ইবে-তে ০.৩ গ্রামের পাথরের মূল্য ২৮৫ ডলার এবং ৩৩.৬৮ গ্রামের আরেকটি পাথরের মূল্য ২৯ হাজার ডলার নির্ধারিত হয়। এই হিসাব থেকেই গ্রাম প্রতি ৮৬০ ডলার মূল্য ধরে ২ কেজি পাথরটির মূল্য ১৮ লাখ ডলার হতে পারে, এই ধারণা করা হয়।

অ্যারিজোনা স্টেট ইনিভার্সিটির স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড স্পেস এক্সপ্লোরেশনের গবেষক ও অধ্যাপক লরেন্স গারভি বিবিসিকে জানান, 'আমি এই হিসাব দেখার পরই হেসে দিয়েছিলাম। আগেও এ ধরনের ঘটনা দেখেছি। অনেকে উল্কাপিণ্ড খুঁজে পাওয়ার পরই ইবে-তে দাম খোঁজা শুরু করে। ছোট পাথরের এত মূল্য দেখেই ধারণা করে নেয়, বড় পাথরের মূল্য আরও বেশি। এভাবেই মূলত দামের ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।'
মহাজাগতিক পাথরের মূল্য
তবে ব্যাপারটি মোটেও এভাবে কাজ করে না। অধ্যাপক গারভি জানান, 'উল্কাপিণ্ডের বয়স পৃথিবীর বয়সের চেয়ে বেশি হওয়ায় এসব মহাজাগতিক বস্তুর প্রতি পৃথিবীর বাসিন্দারা অন্য রকম আকর্ষণ বোধ করে। এ কারণেই অনেকে ছোট ছোট পাথরও অধিক মূল্যে কিনে নেয়। তবে তার মানে এই নয়, পাথরের আকার বৃদ্ধির সঙ্গে দামও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। কেউ-ই বড় পাথরের জন্য মিলিয়ন ডলার খরচ করবে না।'
এমনকি পাথরের আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাম উল্টো কমে যেতে পারে। এ কারণেই উল্কাপিণ্ডের প্রকৃত বাজারমূল্য নির্ধারণ বেশ কঠিন।
এই উল্কাপিণ্ড মূলত মহাজাগতিক মাটির দলা। লোহা, অক্সিজেন, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম ও ক্যালসিয়াম দিয়েই গঠিত এই পাথরগুলো।

তবে এ ধরনের উল্কাপিণ্ডের বৈজ্ঞানিক মূল্য অনেক। আর্থ অবজারভেটরি সিঙ্গাপুরের জেসন স্কট হেরিন বলেন, 'সুমাত্রায় খুঁজে পাওয়া উল্কাপিণ্ডটি মূলত কার্বনেশাস কনড্রাইট। সৌর জগতের প্রথম দিককার এই বস্তুগুলো থেকে পৃথিবী সৃষ্টির আগের অনেক পরিস্থিতিরও ধারণা পাওয়া যেতে পারে।'
পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পৃথিবীতে উল্কাপিণ্ড পতিত হয়। হয়তো এগুলোতে প্রাণের সূচনা লগ্নের কোনো তথ্যও লুকায়িত থাকতে পারে।
জশুয়ার খুঁজে পাওয়া এ ধরনের উল্কাপিণ্ডের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির সূচনালগ্নের ব্যাপারেও হয়তো ধারণা পেতে পারেন। এ কারণেই উল্কাপিণ্ডের ব্যাপারে মানুষের এই প্রবল আগ্রহ।
তবে এর বৈজ্ঞানিক মূল্য থাকলেও মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হবে, এমন ধারণা অবান্তর।
- সূত্র: বিবিসি