কাঁচামালের উপর আমদানি নির্ভরতায় পশুখাদ্যের দাম বাড়ছে

বাংলাদেশ পশুখাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ; কিন্তু এই শিল্পের কাঁচামাল যেমন- ভুট্টা এবং সয়াবিন মিল এখনও আমদানি করায় ফিডের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে লাইভস্টক অর্থনীতিতে সংকটের আশঙ্কা করছেন দেশের ফিড উৎপাদনকারীরা।
আন্তর্জাতিক বাজারে ভুট্টা এবং সয়াবিনের দাম বেড়েছে। এছাড়াও সব ধরনের ফিড কাঁচামালের দামই ৪০% এর মতো বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এই শিল্পে সংকট সৃষ্টি করছে।
উৎপাদন এবং খুচরা পর্যায়ে ফিডের মূল্যবৃদ্ধি পোল্ট্রি, মৎস্য ও গবাদি পশু শিল্পে সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সয়াবিন মিলের রপ্তানির সঙ্গেও আরেকটি সংকট রয়েছে।
দেশের ফিড উৎপাদনকারীদের শঙ্কা, ফিড তৈরীর প্রধান এই উপাদান রপ্তানি হলে স্থানীয় বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সংকট দেখা দিবে, যাতে ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির পাশাপাশি প্রোটিনের যোগানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সর্বোপরি, মহামারিতে সংকটে থাকা পোল্ট্রি ও মৎস্য শিল্পের সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
বিদেশ থেকে সয়াবিন সীড আমদানি করে দেশে তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সয়াবিন মিলের উৎপাদকেরা।
তারা শুল্কমুক্তভাবে সয়াবিন সীড আমদানি করে সয়াবিন তেল উৎপাদন করে। তেল উৎপাদনের পর 'বাই-প্রডাক্ট' হিসাবে সয়াবিন মিল উৎপাদিত হয়, যা পোল্ট্রি, ফিশ ও ক্যাটল ফিডের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল।
সম্প্রতি সিটি সিড ক্রাশার ইন্ডাস্ট্রিজ এবং মেঘনা সীডস ক্রাশিং মিলস- এ দুই প্রতিষ্ঠান ভারতে সয়াবিন মিল রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে।
দেশীয় ফিড মিলগুলো আগে ভারত থেকে সয়াবিন মিল আমদানি করতো। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় ভারত সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধ করেছে।
দাম কিছুটা কম থাকায় বাংলাদেশ থেকে এখন ভারতীয় কোম্পানীগুলো সয়াবিন মিল আমদানি করছে।
সয়াবিন মিল রপ্তানির এই সিদ্ধান্তকে সরকারের অব্যবস্থাপনা বলে মনে করছেন ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সভাপতি ইহতেশাম বি. শাহজাহান।
কোয়ালিটি ফিডস লিমিটেডের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, "সরকার প্রোটিন উৎপাদনে জোর দিচ্ছে কিন্তু প্রাণীখাদ্যের অন্যতম কাঁচামাল সয়াবিন মিল রপ্তানির অনুমতিও দিচ্ছে। এতে দেশীয় পোল্ট্রি খামারি ও ফিড শিল্পের উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।"
ফিডের কাঁচামাল সয়াবিন মিলের সংকট হলে দেশের অনেক মিলে ফিড উৎপাদন বন্ধ হতে পারে বলেও মনে করছে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি)।
এই জন্য পোল্ট্রি, ফিস ও ক্যাটল ফিড তৈরীর অন্যতম উপকরণ সয়াবিন মিল বিদেশে রপ্তানি বন্ধের দাবি জানিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি।
সংগঠনটির মতে, রপ্তানির অনুমতির সিদ্ধান্তে দেশীয় বাজারে প্রতি কেজি সয়াবিন মিলের দাম ৪-৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃত্রিম সংকট তৈরী করে দামও বাড়ানো হয়েছে, যার প্রভাব দেশের পোল্ট্রি শিল্পে পড়তে শুরু করেছে।
করোনার কারণে দেশের লাইভস্টক অর্থনীতির পোল্ট্রি শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক পোল্ট্রি খামার বন্ধও হয়েছে, যাতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এই খাতের বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আর করোনার সময় এই অর্থনীতির সাথে জড়িত ফিড ইন্ডাস্ট্রিও লোকসান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাজেই ফিড উৎপাদনে বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তার মধ্যে পড়েছে এই খাতের উদ্যোক্তারা।
সয়াবিন মিলের চাহিদা বছরে ১৮-২০ লাখ মেট্রিক টন
এই খাতের ব্যবসায়ীদের মতে, বর্তমানে ২০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান পশুখাদ্য তৈরিতে নিয়োজিত।
স্থানীয় কোম্পানিগুলো ব্রয়লার ফিড, লেয়ার ফিড, ফিশ ফিড এবং ক্যাটল ফিড উৎপাদন করে থাকে।
সয়াবিন মিল পোল্ট্রি ও মৎস্যখাদ্যের একটি প্রধান উপাদান। আর পোল্ট্রি ও মৎস্য খাদ্য উৎপাদনে এর ব্যবহার প্রায় ২৫-৩৫% পর্যন্ত।
দেশে বছরে প্রায় ১৮-২০ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন মিলের চাহিদা রয়েছে। যার মধ্যে ৫৫-৬০% স্থানীয়ভাবে বা দেশের সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যোগান দেয়।
আর ভারত, আমেরিকা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে বাকি ৪০-৪৫ শতাংশ আমদানি করা হয়।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সাধারণ সম্পাদক এবং স্পেকট্রা হেক্সা ফিডসের পরিচালক (অপারেশন) আহসানুজ্জামান বলেন, "দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিদেশে সয়াবিন মিল রপ্তানি করলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সংকট দেখা দিবে, যাতে সংকটে পড়বে দেশের পোল্ট্রি ও মৎস্য শিল্প। অনেক ফিড তৈরীকারী প্রতিষ্ঠান টিকতে পারবে না।"
সয়াবিন রপ্তানি বন্ধের বিষয়ে এফআইএবি'র দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, মাছ, মুরগির মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনে মোট ব্যয়ের ৭০% খরচ হয় খাদ্যে। ফিড মিলে মৎস্য ও প্রাণিখাদ্য উৎপাদনে ৭০-৭৫% ব্যয় হয় কাঁচামাল সংগ্রহে।
ভুট্টা, সয়াবিন মিল, চাউলের কুড়া, আটা, ফিস মিল, ময়দা, সরিষার খৈল, তেল, ভিটামিন ও মিনারেল ইত্যাদি ফিডের প্রধান কাঁচামাল, যার অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
চিঠিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও সয়াবিন মিলের দাম বৃদ্ধি করছে। অতীতে ভারত থেকে সয়াবিন মিল আমদানি করা হলেও বর্তমানে ভারতে সয়াবিন মিলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমেরিকা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে কিছু সয়াবিন মিল আমদানি হচ্ছে। সয়াবিন মিল ও ভুট্টাসহ ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত প্রতিটি কাঁচামালের দাম বাড়ছে।
অন্যদিকে উৎপাদিত মাছ, মুরগি, ডিম ও গবাদি পশুর মূল্য নিম্নপর্যায়ে থাকায় খামারিরা চরম লোকসানের মধ্যে রয়েছে। অনেক খামার বন্ধ হয়েছে।
আহসানুজ্জামান বলেন, "আমাদের নিজ দেশেই ফিড তৈরীর কাঁচামালের সংকট রয়েছে, এই অবস্থায় ফিড রপ্তানি দেশীয় শিল্পের জন্য ক্ষতিকর হবে। এর বিপরীতে ভারতীয় খামারিদের জন্য উপকার হবে। দেশীয় খামারিদের ক্ষতির মুখে ফেলে, রপ্তানির সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।"
তিনি বলেন, "ফিডের দাম বাড়লে পোল্ট্রিসহ মাছ ও মাংসের দামও বাড়ছে। আর এই প্রভাব পড়বে সবার উপরই। প্রোটিন যোগানের উপরও প্রভাব পড়বে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশীয় শিল্প। আমরা আশা করি, সরকার এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন।"
এদিকে ইহতেশাম বি. শাহজাহান বলেন, "মহামারির পর যখন দেশীয় শিল্পকে রক্ষায় সহায়তা দরকার, সেখানে সয়াবিন রপ্তানি হলে ফিড উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রোট্রিন নিশ্চিতে জোর দিচ্ছেন সত্যিই কিন্তু সয়াবিন মিল রপ্তানি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।"
বর্তমানে স্থানীয় পোল্ট্রি এবং ফিড শিল্পের বাজার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার; এ খাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
পোল্ট্রি, মৎস্য এবং গবাদি পশু পালনের প্রভাবে গত দশকে পশুখাদ্য শিল্প প্রায় ২৫% সম্প্রসারণ করেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, খাতটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২-১৫% এবং গত সাত বছরে ফিড উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬১%।