তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে সুপ্রিম কোর্টের রায়, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে কার্যকর হচ্ছে না
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দিয়েছেন দেশের সব্বোর্চ আদালত।
তবে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমিকভাবে বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটি কার্যকর হবে না।
আজ বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ এ রায় ঘোষণা করেন। ২০১১ সালের যে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাটি বাতিল করা হয়েছিল, তা নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক ও আইনি পর্যালোচনার পরই এই রায় এলো।
বেঞ্চের অপর ৬ জন বিচারপতি হলেন— বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
আদালত ঘোষণা করেছেন, ১৯৯৬ সালে ১৩তম সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে চালু হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখন 'পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো'। আদালত রায় নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, আগের রায়টিতে রেকর্ড অনুযায়ী বেশ কিছু স্পষ্ট ত্রুটি ছিল। এসব ত্রুটির কারণে সেই রায়টি পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে।
২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন। গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ রায় চ্যালেঞ্জ করে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক রিভিউ আবেদন করেন।
একই ইস্যুতে বিএনপি, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামী এবং আরও একজন পৃথক রিভিউ আবেদন করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেন আপিল বিভাগ।
দশ কার্যদিবস ধরে শুনানি শেষে গত ১১ নভেম্বর আপিলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ২০ নভেম্বর রায়ের দিন ধার্য করেন।
বদিউল আলমের পক্ষে শুনানি করেন ড. শরীফ ভুইয়া; বিএনপির পক্ষে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল; মির্জা ফখরুলের পক্ষে ব্যারিস্টার জয়নুল আবেদীন এবং জামায়াতের পক্ষে মোহাম্মদ শিশির মনির।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, 'আজকের রায়ে আপিল বিভাগ এই রায় বাস্তবায়নে 'প্রসপেক্টিভ ইফেক্ট' দিয়েছেন, অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে যে সংসদ গঠিত হবে, সেটি ভেঙে যাওয়ার পর কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে। এই রায়ের ফলে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলো। ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা হয়েছিল, সেটাকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক না বলে 'সাংবিধানিক' হিসেবে ঘোষিত হলো।'
তিনি বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সাথে সহায়ক হিসেবে ঘোষিত হলো, এই বিষয়টি হয়তো আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে উঠে আসবে। আজ থেকে বাংলাদেশের মানুষ আগামী দিনে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন, দিনের ভোট রাতে হবে না, মৃত মানুষ এসে ভোট দিয়ে যাবেন না, এরকম একটি গণতান্ত্রিক মহাসড়কে বাংলাদেশ চলা শুরু করলো বলে অমরা মনে করি।'
জুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার যে রূপরেখা আছে—তার পরিবর্তন সম্ভব হবে কি না জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'পার্লামেন্টের কিছু ডিসকাশন থাকবে। ২০ বছর পরে জনগণ যদি মনে করে এই ব্যবস্থা পচে-গলে গেছে, এর থেকেও ভালো কোনো ব্যবস্থা গণতন্ত্র সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন, তাহলে অবশ্যই পার্লামেন্টের ডিসকাশন থাকবে।'
একই আপিল বিভাগে তার আগের রায়কে কলঙ্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ বলার ব্যাখ্যা জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, 'ত্রুটিপূর্ণ ও কলঙ্কিত বলেই ওই রায় বাতিল করা হয়েছে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা কারণ ছিল, এই রায় লেখার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও তার সহযোগীরা দণ্ডবিধির ২১৯ ধারায় অপরাধ করেছেন।'
গণতন্ত্রের স্বার্থে ভবিষ্যতে আবার এই রায় নিয়ে কোনো মন্তব্য আসবে না বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, 'আজকের রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরেছে। তবে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হবে। চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে। অর্থাৎ সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গঠিত হবে।'
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দস কাজল বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এই রায়টি সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ রায়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই সরকার ব্যবস্থা আনয়ন করে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। ২০১১ সালে আপিল বিভাগ সেই সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। আজকের রায়ের ফলে, সংবিধানে এই সরকার ব্যবস্থা অটোমেটিক্যালি পুনরুজ্জীবিত হলো, মানুষের ভোটের অধিকার আবারও প্রতিষ্ঠিত হলো।'
তিনি বলেন, 'কিন্তু আদালত রায়ে বলেছেন, এই রায়ের কার্যকারিতা ভবিষ্যতে অর্থাৎ আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে না। এটি কার্যকর হবে আগামী চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।'
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দস বলেন, 'আজকের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে যে রায় দিয়েছে, সেই রায়ের পরতে পরতে ত্রুটি ছিল। ফলে খায়রুল হকের রায় পুরোই বাতিল করেছেন আদালত।'
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের আইনজীবী জয়নুল আবদিন বলেন, 'এই রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হল। জনগণ এখন নির্দ্বিধায় ভোট দিতে পারবে।'
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের চাপে তৎকালীন বিএনপি সরকার ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে। পরে ১৯৯৮ সালে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট হয়। ২০০৪ সালে রিট খারিজ হলে ব্যবস্থা বহাল থাকে।
২০০৫ সালে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। ২০০৬ সালের রাজনৈতিক সংকট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়। অ্যামিকাস কিউরিসহ সবাই কেয়ারটেকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে ছিলেন।
২০১১ সালের ১০ মে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তিসহ ৫৫টি সংশোধনীসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং ৩ জুলাই তা অনুমোদন পায়।
গত ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ পঞ্চদশ সংশোধনীর ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানবিরোধী ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। ফলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরার পথ তৈরি হয়।
