গোপালগঞ্জে সংঘর্ষ: ৪ দিন পর ৪ হত্যা মামলা; আসামি ৬ হাজার

গোপালগঞ্জে গত বুধবার (১৬ জুলাই) জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে পাঁচ জন হত্যার চার দিনের মাথায় পৃথক চারটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে ।
এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ রমজান মুন্সি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি হত্যা মামলা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া, ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন ও সৎকার করা চার জনের মৃত্যুর ঘটনায় চার পুলিশ কর্মকর্তা বাদী হয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানায় গতকাল শনিবার গভীর রাতে হত্যা মামলা চারটি দায়ের করেন।
শনিবার রাতে এসব মামলার তথ্য আজ রোববার (২০ জুলাই) নিশ্চিত করেন গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান। এছাড়া, আরেকটি হত্যায় মামলা করা হবে বলেও জানা গেছে।
দায়ের করা প্রতিটি মামলায় ১০০-১৫০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এ চার মামলায় ৬ হাজার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
জানা যায়, গোপালগঞ্জ সদর থানার এসআই মো. আইয়ুব হোসেন বাদী হয়ে রমজান কাজী (১৭) হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মামলা দায়ের করেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণের জানা যায়, গত বুধবার (১৬ জুলাই) এনসিপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষে পৌর পার্ক থেকে দুপুরে মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে গাড়িবহর নিয়ে রওনা দিয়ে নেতৃবৃন্দ গোপালগঞ্জ শহরের এসকে সালেহিয়া মাদ্রাসার কাছে পৌঁছালে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং দুষ্কৃতকারীরা গাড়ি বহরে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও আগ্নেয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে।
পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ আইন শৃখলারক্ষা বাহিনী এতে বাধা দেয়। হামলাকারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি চালায়। এ সময় রমজান কাজী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন।
স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সদর থানার এসআই মো. শামীম হোসেন বাদী হয়ে দীপ্ত সাহা (২৭) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গোপালগঞ্জ সদর থানায় ১৯ জুলাই গভীর রাতে অজ্ঞাত ১৪০০-১৫০০ জনকে আসামি করে ওই থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, গত বুধবার এনসিপির গাড়ি বহরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং দুস্কৃতকারীদের হামলার ঘটনা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। কলেজ মসজিদের পাশে মিলন ফার্মেসির সামনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এটি প্রতিরোধ করতে গেলে হামলাকারীরা গুলি করে। সেখানে দীপ্ত সাহা গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।
সংকটজনক অবস্থায় তাকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। দণ্ডবিধি আইনের ১৪৭/১৪৮/১৪৯/১৮৬/৩৫৩/৩০৭/৩০২/৩৪ পেনাল কোড ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
একই থানার এসআই আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে সোহেল রানা মোল্লা (৩০) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শনিবার গভীর রাতে সদর থানায় ১৪০০-১৫০০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, লঞ্চঘাট এলাকায় হোটেল রাজের সামনে দুষ্কৃতকারীরা এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনী এগিয়ে আসলে তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় দুষ্কৃতকারীরা ।
এ সময় সোহেল রানা মোল্লা মারাত্মক আহত হন। তাকে উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশের এসআই শেখ মিজানুর রহমান বাদী হয়ে ১৪০০-১৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে ইমন তালুকদার হত্যা মামলা দায়ের করেছেন । ঘটনার দিন গত ১৬ জুলাই আসামিরা শহরের পুরাতন সোনালী ব্যাংকের সামনে এনসিপির গাড়ি বহরে হামলা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতে বাধা দিলে দুস্কৃতকারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ইমন তালুকদার আহত হয়। পরে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
জানা যায়, গোপালগঞ্জে এনসিপি'র সমাবেশ ঘিরে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার ২৭৭ জনকে এ পর্যন্ত কারাগারে পাঠানো হয়েছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় তাদের ১৭৭ জনকে জেলা কারাগারে রেখে বাকি ১০০ জনকে শনিবার পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তারদের মধ্যে অন্তত ৯ শিশু হওয়ায় তাদের রোববার যশোরের পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কথা রয়েছে।
আজ দুপুরে কারাফটকের সামনে থাকা মোজাম্মেল শেখ বলেন, 'আমার ভাইগনে আসিফ মোল্লার বয়স ১৬ বছর হইছে। সে বিসিক এলাকার ভাই-ভাই বেকারিতে কাজ করে। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে কারখানা থেকে বারইয়া [বের হয়ে] পাশের খালে গোসল করতে যায়। সেখানে তারেসহ পাঁচজনরে ধরে পুলিশ।'
বুধবার হামলা-সংঘর্ষের সময় সে কারখানাতেই ছিল বলে জানান মোজাম্মেল।
একই বয়সের আরেক কিশোর প্রিন্স অধিকারীকে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে কোটালীপাড়ার আমতলী মনসাবাড়ী এলাকার বাসার সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তার বাবা প্রদীপ অধিকারী ও মা লিপিকা অধিকারী জানান, 'এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এক বিষয়ে ফেল করে প্রিন্স। এ কারণে বাসায় থেকে সামনের বছর ভালো ফল করার জন্য পড়ালেখা করছিল। বুধবার সে বাসাতেই ছিল। তাকে কেন ধরা হয়েছে, বুঝতে পারছিলেন না এই দম্পতি।'
আমতলী মনসাবাড়ী এলাকার তরুণ রিফাত বিশ্বাস (২০) তার মামা সোহেল হোসেনের প্রসাধন সামগ্রীর দোকানে কাজ করেন। কোটালীপাড়া থানার কাছেই দোকানটি।
তার মামী শাকিলা আক্তার তুলি বলেন, 'আমাগের কাছেই বড় হইছে রিফাত। আমাগের বাসায় থাকে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার সময় আমতলী থেকে তারে ধরে আনে পুলিশ।'
বুধবার শহরে সংঘর্ষের সময় তিনি দোকানেই ছিলেন বলে জানান স্বজনরা।
দুই বছর ধরে মালয়েশিয়ার একটি কারখানায় কাজ করেন গোপালগঞ্জ সদরের স্লুইসগেট এলাকার আবু দাউদ (২৩)। ঈদুল আজহার আগে তিনি ছুটিতে দেশে আসেন। তাকে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে বাসার অদূরে গ্রেপ্তার করা হয়।
তার মা কোহিনূর বেগম বলেন, 'বন্ধুগের সঙ্গে বাসার সামনে চা খাতি গ্যাছেল। তহন তারে ধরে নিয়ে যায়। আমার ছেলে মাদ্রাসায় হাফেজি পড়েছে। পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে। ওরে কেন ধরেছে কতি পারেন?'
কারাফটকে থাকা কারারক্ষী রিপন শেখ জানান, বুধবার কারাগারে হামলা হওয়ায় সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তাই আপাতত কারো সঙ্গে দেখা করার সুযোগ মিলছে না।
থানার সামনে অপেক্ষা
মেরি গোপীনাথপুরের বোয়ালিয়া হাট এলাকায় রড-সিমেন্টের ব্যবসা করেন মামুন শেখ (২২)। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তাকে দোকান থেকে ধরে আনে পুলিশ।
তার ভাই তরিকুল ইসলাম ভাইয়ের খোঁজে শনিবার এসেছিলেন সদর থানার সামনে।
তিনি বলেন, 'আমার ভাই রাজনীতি করে না। বুধবার হাটের দিন সে দোকানেই ছেল। অথচ পুলিশ তারে ধরে নেছে।'
ভ্যানের ওপর বসে হাপুস নয়নে কাঁদছিলেন বিনতা ভৌমিক।
তিনি জানান, তার ছেলে সুমন ভৌমিক (৩৫) পেশায় রাজমিস্ত্রি। বাসায় একটি মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে। সে জন্য ইটের খোয়া কিনতে তিনি শনিবার সকাল ১০টার দিকে বৈলতল বাজারে যান। সেখান থেকে তাকে আটক করে পুলিশ। তার বাবা সুশীল ভৌমিক স্ট্রোক করে অসুস্থ। ছেলের আটকের খবরে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
মাহিন্দ্র চালক তুফান সিকদারকে (২৪) শুক্রবার সন্ধ্যায় সদরের বেতগ্রাম থেকে আটক করে পুলিশ।
তার মামা কাইয়ুম শেখ বলেন, 'পাম্পে তেল ভরতি গ্যাছেল। তহন তারে ধরেছে।'
তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত নন বলে দাবি করেন স্বজনরা।
এমন আরও পরিবারের সদস্যদের দেখা মেলে থানার সামনে। সবারই প্রায় একই অভিযোগ, বিনা কারণে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে।