বক্স অফিসে সুপারহিরোদের দাপট, কিন্তু জায়গা হলো না সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায়

গত ২৫ বছরের চলচ্চিত্র ইতিহাসে চোখ বোলালে একটি বিষয় অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, ২১ শতকের বড় পর্দার বিনোদনে সুপারহিরো সিনেমাগুলোই এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অনেকেই ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া 'আয়রন ম্যান' সিনেমাটিকে এই ধারার আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসেবে দেখেন।
এই সিনেমার মাধ্যমেই শুরু হয় এক বিশাল বাণিজ্যিক যাত্রা, যা দর্শকদের উপহার দিয়েছে একের পর এক ব্লকবাস্টার, সিক্যুয়েল, পর্বে পর্বে সাজানো সিরিজ এবং নিজস্ব 'সিনেমাটিক ইউনিভার্স'।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, মার্ভেল বা ডিসি কমিকসের এসব সুপারহিরো সিনেমার প্রায় কোনোটিই নেই নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর তৈরি ২১ শতকের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায়!
হলিউডের প্রভাবশালী পরিচালক, অভিনেতা ও অন্যান্য গুণীজনদের ভোটে তৈরি এ তালিকায় 'আয়রন ম্যান'-এর মতো চলচ্চিত্রের না থাকাটা বিশেষভাবে চোখে পড়ে।
তবে বিষয়টি নিয়ে সবাই যে খুব অবাক হয়েছেন, এমনটাও নয়।
দর্শকরা হয়তো সামনের দিনগুলোতে মার্ভেল সিনেমার টিকিট কিনবে, পরিচিত চরিত্রদের প্রতি পুরনো আবেগ, সেই সাথে সিনেমার দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য, চোখ ধাঁধানো ভিএফএক্স-ও উপভোগ করবে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাটিকে 'সেরা চলচ্চিত্র'-র মর্যাদা দিতে অনেকেই পিছিয়ে যান।
তবে এক্ষেত্রে আরেকটি দিকও বিবেচনার দাবি রাখে। বছরের পর বছর ধরে সিনেমা ও টিভি স্ক্রিনে সুপারহিরো কনটেন্টের অতিরিক্ত উপস্থিতি অনেক দর্শক, এমনকি সবচেয়ে অনুগত ভক্তদের মধ্যেও ক্লান্তি এনে দিয়েছে।
একে বলা হয় 'সুপারহিরো ফ্যাটিগ'—যেখানে একই ধরনের গল্প, চরিত্র ও টোন বারবার দেখে দর্শকের আগ্রহে ভাটা পড়ে। এমনকি এই ঘরানায় যেসব চলচ্চিত্র প্রশংসিত হয়েছে, তারাও এই ক্লান্তির রেশ এড়িয়ে যেতে পারেনি।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এসব সিনেমা আলাদা করে বিচার করাও দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, অনেক সময়েই এগুলো তৈরি হয় বড় কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজির অংশ হিসেবে, স্বাধীন শিল্পকর্ম হিসেবে নয়।
তালিকায় স্থান পাওয়া দুটি সুপারহিরো সিনেমার একটি ক্রিস্টোফার নোলানের 'দ্য ডার্ক নাইট', আরেকটি মার্ভেল প্রযোজিত 'ব্ল্যাক প্যান্থার'। দুটি সিনেমাই দেখিয়ে দিয়েছে, কমিক বইয়ের গল্প ও চলচ্চিত্রশৈলীর মধ্যে সেতুবন্ধ সম্ভব।
সেই সাথে সুপারহিরো ঘরানা কেবল স্প্যান্ডেক্স, সিজিআই বা অতিনাটকীয়তায় সীমাবদ্ধ নয়, সুপারহিরো ঘরানায়ও শিল্পমান বজায় রাখাও সম্ভব।
বিশেষ করে 'দ্য ডার্ক নাইট'–এর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল এর গম্ভীর ও বাস্তববাদী আবহ, সেই সাথে ক্রিশ্চিয়ান বেল, গ্যারি ওল্ডম্যানের মতো প্রথিতযশা অভিনেতাদের উপস্থিতি।
এমন এক জগৎ, যেখানে আইনের সঙ্গে ন্যায়বিচার সবসময় মেলে না, সেখানে বিশৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যকার দ্বন্দ্বে কীভাবে নায়ক ন্যায়বিচারের প্রতীক হয়ে ওঠে তার তাৎপর্যকে ঘিরেই সিনেমাটির বিশ্লেষণ।
অন্যদিকে 'ব্ল্যাক প্যান্থার' কেবল শতকের প্রথম বড় বাজেটের ব্ল্যাক সুপারহিরো সিনেমা-ই না, বরং এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সমাজ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণও।
সিনেমাটিতে কৃষ্ণাঙ্গ প্রধান চরিত্র, কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতি এবং এক মনোমুগ্ধকর কৃষ্ণাঙ্গ ইউটোপিয়ার বাইরে ছিল অভিবাসনের কারণে আফ্রিকান ও আফ্রিকান-আমেরিকানদের মাঝে গড়ে ওঠা দূরত্ব ও বিভাজনকে কেন্দ্র করে এক গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যা।
এই দুই সিনেমা একসাথে স্থান পেয়ে অর্থবহ হয়ে ওঠার আরেকটি কারণ, দুটিতেই এমন দুই অভিনেতা ছিলেন—হিথ লেজার ও চ্যাডউইক বোসম্যান—যারা এই সিনেমায় নিজেদের চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে তাদের ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ পারফরম্যান্স দিয়েছেন। এবং আজ তারা কেউই বেঁচে নেই।
অন্যান্য অনেক সুপারহিরো সিনেমাও রয়েছে, যেগুলো তালিকায় থাকা মোটেই অপ্রত্যাশিত হত না। যেমন, এক সময়কার সবচেয়ে প্রিয় এক্স-ম্যান চরিত্রের বিদায়ের আবেগঘন গল্পকে ঘিরে 'লোগান', অনন্য ভয়েস ক্যাস্ট এবং ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং এর জন্য 'স্পাইডার-ম্যান: ইনটু দ্য স্পাইডার-ভার্স','গার্ডিয়ানস অব দ্য গ্যালাক্সি'-এর অসাধারণ সাউন্ডট্র্যাক এবং বেপরোয়া হাস্যরস ও প্রাণবন্ত অ্যাকশন এর জন্য 'ডেডপুল'।
তবুও, এই শতাব্দীর কমিকবুক সিনেমাগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তার পরেও অনেকের কাছে এসব সিনেমা 'শতাব্দীর সেরা সিনেমা'-র মর্যাদা পায়নি। এগুলো এখনো চলচ্চিত্র জগতের সাধারণ বিনোদন হিসেবে দেখা হয়, অনেকটা 'পপকর্ন ফিল্ম' এর মতো।
তবে পাঠকদের শীর্ষ ১০০ সিনেমার তালিকায় সুপারহিরো সিনেমার উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। 'স্পাইডার-ভার্স' সেখানে স্থান পেয়েছে, পাশাপাশি 'লর্ড অব দ্য রিংস'–এর তিনটি কিস্তিও জায়গা পেয়েছে। এছাড়া 'ডিউন' ও 'ব্লেড রানার ২০৪৯' মতো শৈল্পিক ঘরানার সিনেমাগুলোও তালিকাভুক্ত হয়েছে।
পিক্সারের 'দি ইনক্রেডিবলস' ও স্টুডিও ঘিবলির 'হাউল'স মুভিং ক্যাসেল'–এর মতো অ্যানিমেশনগুলোও শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলোর তালিকায় আছেন।
পাঠক নির্বাচিত তালিকায় আরেকটি মার্ভেল সিনেমাও রয়েছে, যা প্রায় দুই লাখেরও বেশি ভোটের মাধ্যমে গঠিত। এটি প্রমাণ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস–এর পাঠকরাও সুপারহিরো ঘরানার সিনেমাগুলোকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন।
শীর্ষ ১০০–এর তালিকায় জায়গা পেয়েছে 'অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম' (২০১৯)। প্রায় দুই ডজন সিনেমার দশ বছরের ধারাবাহিকতার ক্লাইম্যাক্স এর পর মূল কাহিনী এবং আবেগঘন সমাপ্তি টেনে সিনেমাটি একটি যুগের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিল।
সিনেমাটির পর সুপারহিরো ঘরানার বিস্তারের পর প্রথমবারের মতো মাল্টিভার্সের পুনঃস্থাপনার প্রয়োজন পড়ে এবং ভক্তরা অনিশ্চয়তায় পড়ে যান ভবিষ্যতে ফ্র্যাঞ্চাইজিটি কোন পথে যাবে।
এখন 'এন্ডগেম' মুক্তির ছয় বছর পর, এর ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রভাব কিছুটা ম্লান হলেও, 'অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম', 'দ্য ডার্ক নাইট', 'ব্ল্যাক প্যান্থার' এবং 'স্পাইডার-ম্যান: ইনটু দ্য স্পাইডার-ভার্স'–এর মতো সিনেমাগুলো আজও স্মরণ করিয়ে দেয় সেই সময়টিকে, যখন সিনেমার ভক্ত-প্রেম শুধু একটি স্বাভাবিক ব্যাপারই ছিল না, বরং রাজত্ব করেছিল পুরো সিনেমা জগতে।