কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে এনবিআর পুনর্গঠন অপরিহার্য: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়

বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত অন্তত ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কাঠামোগত পুনর্গঠন অপরিহার্য বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
আজ মঙ্গলবার (১৩ মে) প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে দেওয়া এক বিবৃতিতে প্রেস উইং বলেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এনবিআর ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এনবিআর ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
"বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে প্রায় ৭.৪ শতাংশ, যা এশিয়ার অন্যতম সর্বনিম্ন। যেখানে বৈশ্বিক গড় অনুপাত ১৬.৬ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় এটি ১১.৬ শতাংশ। জনগণের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা পূরণে বাংলাদেশের জন্য অন্তত ১০ শতাংশ কর-জিডিপি অনুপাত অর্জন অত্যাবশ্যক,"—বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা হয়, এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত— কর নীতিনির্ধারণ ও কর প্রশাসনকে পৃথক করে দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বার্থের সংঘাত নিরসন এবং করের আওতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে।
"একটি প্রতিষ্ঠানের একই সঙ্গে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করে এবং অদক্ষতা বাড়ায়—এনিয়ে ক্রমবর্ধমান ঐক্যমত তৈরি হয়েছে,"—বলেও জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
প্রেস উইং বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন যে এনবিআর-এর নীতিমালায় রাজস্ব আহরণের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, যেখানে ন্যায্যতা, প্রবৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।
দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো
স্বার্থের সংঘাত
একই প্রতিষ্ঠান নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ফলে কর নীতিতে দুর্বলতা ও ব্যাপক অনিয়ম দেখা দিয়েছে। বর্তমানে কর সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের জবাবদিহির কোনো কাঠামো নেই এবং তারা প্রায়ই কর ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে জনস্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে কর আদায়কারীরা ফাঁকিবাজদের সহায়তা করেন ব্যক্তিগত স্বার্থে।
কর আহরণকারীর কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য কোনো নিরপেক্ষ পদ্ধতি নেই এবং তাদের পদোন্নতি নির্ভর করে না নির্দিষ্ট কর্মক্ষমতা নির্দেশকের ওপর।
অদক্ষ রাজস্ব সংগ্রহ
দ্বৈত দায়িত্ব পালনের কারণে নীতিনির্ধারণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গঠনে মনোযোগ বিভক্ত হয়েছে। এর ফলে করের আওতা সংকুচিত থেকেছে এবং রাজস্ব সংগ্রহ সম্ভাবনার তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে।
দুর্বল শাসনব্যবস্থা
এনবিআরে আইন প্রয়োগে অসঙ্গতি, বিনিয়োগ সহায়তায় দুর্বলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বল শাসনের ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়েছে।
প্রশাসনে দ্বৈততা
বর্তমান কাঠামোতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব একইসঙ্গে এনবিআরেরও প্রধান হওয়ায় বিভ্রান্তি ও অদক্ষতা দেখা দিয়েছে, যা কার্যকর কর নীতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করেছে।
কর্মীদের হতাশা ও অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা
এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ কর ও শুল্ক কর্মকর্তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হয়েছে, কারণ অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে তারা উপেক্ষিত হতে পারেন।
কীভাবে এই পুনর্গঠন সহায়ক হবে
নতুন কাঠামো এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে আরও স্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো গড়ে তুলবে।
দায়িত্বের স্পষ্ট বিভাজন
রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রণয়ন, করহার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কর চুক্তি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ বাস্তবায়ন, অডিট ও পরিচালন তদারকি করবে। এই বিভাজন নিশ্চিত করবে যে, কর নির্ধারণকারী কর্মকর্তারা আর কর সংগ্রহের দায়িত্বে নেই, ফলে অপব্যবহারের সুযোগ কমবে।
দক্ষতা ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন
প্রতিটি বিভাগ তার নিজস্ব কার্যক্রমে মনোযোগ দিতে পারবে, বিশেষায়িত জ্ঞান বাড়বে, স্বার্থের সংঘাত কমবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সততা উন্নত হবে।
করভিত্তি সম্প্রসারণ ও প্রত্যক্ষ কর জোরদার
এই সংস্কার করের আওতা বাড়াবে, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমাবে এবং উপযুক্ত পদে দক্ষ পেশাজীবীদের নিয়োগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহকে আরও শক্তিশালী করবে।
উন্নয়নমুখী নীতিমালা
একটি স্বতন্ত্র নীতিনির্ধারণ ইউনিট তথ্য-নির্ভর, ভবিষ্যতমুখী কৌশল প্রণয়ন করতে পারবে, যা শুধু স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে নয়।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি
স্বচ্ছ, পূর্বানুমেয় নীতি এবং পেশাদার কর প্রশাসন বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে এবং বেসরকারি খাতের অভিযোগ হ্রাস পাবে।
পরিশেষে এই কাঠামোগত সংস্কার কেবল একটি প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস নয়—এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ, যা একটি ন্যায্য, দক্ষ ও সক্ষম কর ব্যবস্থা গঠনের দিকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যা শক্তিশালী নীতিনির্ধারণ ও দুর্নীতিমুক্ত কর প্রশাসন বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা পূরণ এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে অপরিহার্য।