চট্টগ্রামের ভাষায় প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে উচ্ছ্বসিত রোহিঙ্গারা ঘরে ফেরার স্বপ্নে বিভোর

ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। সেই স্বপ্ন তৈরি করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল শুক্রবার (১৪ মার্চ) রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উদ্দেশে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া ভাষণ ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নারী পুরুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাভাষী রোহিঙ্গারা সহজেই বুঝতে পেরেছেন প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য। বুঝতে পেরেছেন তিনি কী বলতে চেয়েছেন। জানতে পেরেছেন রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার যে আকুতি, সে ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ও তার সরকারের আন্তরিক উপলব্ধি।
ড. ইউনূস ও জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস শুক্রবার কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে ইফতার করেন। ইফতারের আগে ড. ইউনূস রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় পাঁচ মিনিটেরও বেশি সময় কথা বলেন।
তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) যখন আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন রোহিঙ্গাদের চোখে-মুখে ছিল আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ছাপ।
প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা এবং কক্সবাজারের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতারা মনে করছেন, ড. ইউনূস শুধু বাংলাদেশের সরকার প্রধান নন, তিনি বিশ্বনেতাও। তাই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দেওয়া বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা কমিউনিটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগাযোগের একটা সংযোগ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গারা জাতিসংঘের মহাসচিবকে বলতে পেরেছেন তাদের মনের কথাগুলো। ফলে শুক্রবার দুই নেতার সফরের মধ্যদিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ২০১৭ সালে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর দেশি-বিদেশি অনেক বড় বড় নেতা আশ্রয় শিবির সফর করেছেন। কিন্তু ভাষা বুঝতে না পারার কারণে রোহিঙ্গারা এতদিন মনের কথাগুলো সরাসরি কোনো নেতাকে বলতে পারেননি। শুক্রবার অধ্যাপক ইউনূস স্যারকে তারা মনের কথাগুলো বলতে পেরেছেন।
একইসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা-ও রোহিঙ্গা কমিউনিটির লোকজন বুঝতে পেরেছেন। আশা করি এবার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
প্রধান উপদেষ্টা আঞ্চলিক ভাষায় দেওয়া বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে আশ্রয় শিবিরের (ক্যাম্প-১) রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা আলী হোসেন বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার দীর্ঘ ৮ বছর যে সমস্যার কথাগুলো বলতে পারিনি, শুক্রবার তা দুজন বিশ্বনেতাকে বলার সুযোগ হয়েছে। শুধু তা সম্ভব হয়েছে অধ্যাপক ইউনূস স্যারের কারণে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রোহিঙ্গাদের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার কিছুটা অমিল থাকলেও প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া বক্তব্য রোহিঙ্গা কমিউনিটির প্রত্যেক মানুষ বুঝতে পেরেছেন। এটা খুবই ইতিবাচক। কারণ, এ বক্তব্যের মধ্যদিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি করতে পেরেছেন প্রধান উপদেষ্টা। যা গত ৮ বছরে দেশি-বিদেশি কোনো নেতা করতে পারেননি।
ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের (মিয়ানমার থেকে) তাড়িয়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশে এসে জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এখন এই মাসের ১৪ তারিখ আবার তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে ক্যাম্পে এসেছেন।
আন্তোনিও গুতেরেসের কাছে রোহিঙ্গাদের যে কথাগুলো ড. ইউনূস তুলে ধরেছেন, তা হলো- 'আন্তোনিও গুতেরেসকে একটা কথাই বলেছি, বাংলাদেশ আমাদের (রোহিঙ্গাদের) দেশ নয়। এই ক্যাম্পে আর দীর্ঘ সময় থাকতে চাই না। এখন ক্যাম্প জীবনের ৮ বছর চলছে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে আরাকানে নিরাপদ জোন করে দিন, আমরা স্বদেশে এক্ষুণি চলে যেতে চাই।' এটাই অনুরোধ করেছি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের কাছে।
এ কথা প্রধান উপদেষ্টা আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, 'জাতিসংঘ মহাসচিব অনারার হাছে দুঁরি আইস্যেদে, অনারার এক্কানা সাহস অইবার লাই। তেঁই অনারারলাই আবার দুনিয়ার সামনে লড়াই গরিবু, যাতে অনারারে শান্তিপূর্ণভাবে অনারার দেশত পৌঁছাই দিত পারে। ইয়ান মস্ত বড় খুশির হতা। এই খুশির হতা আজিয়া আঁরা অনুভব গরির। আঁরা তাঁরে (আন্তোনিও গুতেরেস) ভীষণভাবে ধন্যবাদ জানাই।' (জাতিসংঘ মহাসচিব আপনাদের কাছে এসেছেন আপনাদের সাহস দেওয়ার জন্য। শান্তিপূর্ণভাবে আপনাদের দেশে পৌঁছে দিতে তিনি লড়াই করবেন। এটি মস্তবড় খুশির কথা। এই খুশির কথা আজ আমরা অনুভব করছি। আমরা তাঁকে ভীষণভাবে ধন্যবাদ জানাই।)
প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রামের ভাষায় আরও বলেন, 'তাঁরে কি হনঅ দেশত আনিত ফারেন না, তার দেশত। বনজঙ্গলর ভিতর ঢুকাইত পারিব না? পাইত্তো নঅ। তাঁরা সরকারঅর বড় বড় হর্তা অলর লই হতা কঅই। এ জঙ্গলর ভিতর যনর হতা নঅ। তেঁই (আন্তোনিও গুতেরেস) হষ্ট গরি আইস্যে। নিজে রোজা রাইক্কে আজিয়া অনারারলাই।' (তাকে কি কোনো দেশ আনতে পারছে তাদের দেশে? বনজঙ্গলে ঢোকাতে পারবে? পারবে না। তারা সরকারের বড় বড় কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এই জঙ্গলের ভেতর যাওয়ার কথা নয়। তিনি কষ্ট করে এসেছেন। আজ আপনাদের জন্য নিজে রোজা রেখেছেন।)
ড. ইউনূস বলেন, 'তাঁরে (আন্তোনিও গুতেরেস) আঁরা বারেবারে যিয়ান বুঝাইতাম চাইর, তা অইল, ঈদ আইলে আঁরা বেয়াগ্গুন যাই দাদুদাদির হবর জিয়ারত গরি। নানুনানির হবর জিয়ারত গরি। আত্মীয়স্বজনর হবর জিয়ারত গরি। এই মানুষগুইন এডে আইয়েরে ঈদগান গরিবদে এই সুযোগ পাইত নঅ। ইতারার হবর জিয়ারত গরিবার হনঅ সুযোগ নাই। তাঁরে অনারা এক্কান দাওয়াত দঅন। দাওয়াত দিবেন যে কিল্লাই; সাম্মোর বছর ঈদর সমত যেন অনারার বাড়ির মইধ্যে তেঁই (আন্তোনিও গুতেরেস) আইয়ে। ইয়ুর মইধ্যে এহত্র হঅন এবং দাদুদাদির হবরঅর মইধ্যে যাইয়েনে তাঁরে সংবর্ধনা দঅন।'
(তাকে (আন্তোনিও গুতেরেস) আমরা বারবার যেটি বোঝাতে চাইছি, তা হলো, ঈদ এলে আমরা সবাই দাদাদাদির কবর জিয়ারত করি। নানানানির কবর জিয়ারত করি। আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করি। এই মানুষগুলো (রোহিঙ্গা শরণার্থী) এখানে এসে সে সুযোগ পাচ্ছে না। তাঁদের কবর জিয়ারত করার সুযোগ নেই। তাঁকে (আন্তোনিও গুতেরেস) আপনারা দাওয়াত করুন। সামনের বছর ঈদের সময় যেন আপনাদের বাড়িতে তিনি আসেন। আপনাদের বাড়িতে একত্র হন এবং দাদাদাদির কবর জিয়ারত করে তাঁকে সংবর্ধনা দেন।)
প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বলেন, 'আঁরা এতুগ্গুন মানুষ আইস্যি। তাঁরে আঁরা বুঝাইর, অনারাও বুঝাইতেন লাইগ্গুন। কেউ আঁরারে আইয়েরে ভাত হাবাই যঅক, ইয়ান ত আঁরা ন চাই। আঁরারতো নিজর ক্ষমতা আছে। ধনসম্পদ আছে, জায়গাসম্পত্তি আছে। আঁরাতো গরিত পারির। আঁরারে দেশত যাইত ন দে বলি, আঁরা মাইনষর বোঝা অই গেইগই। আঁরার পুয়া ছা বড় অইতো চার। দাদাদাদির হবরঅর পাশে, নিজর ঘরর পাশে, আত্মীয়স্বজনর পাশে; ইয়ান আঁরা ন পারির। তাঁরে (আন্তোনিও গুতেরেস) আঁরা বুঝাইর।'
(আমরা এত মানুষ এসেছি। তাকে আমরা বুঝিয়েছি। আপনারাও বুঝাচ্ছেন, কেউ আমাদের এসে ভাত খাইয়ে যাক, তা আমরা চাই না। আমাদের নিজেদেরই ক্ষমতা আছে। ধনসম্পদ আছে। জায়গাসম্পত্তি আছে। আমরাও করতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা এখন মানুষের বোঝা হয়ে গেছি। আমাদের ছেলেমেয়ে দাদাদাদির কবরের পাশে, নিজের ঘরের পাশে, আত্মীয়স্বজনের পাশে বড় হতে চায়, কিন্তু আমরা তা পারছি না। তাঁকে এসব বিষয় আমরা বোঝাব।)
এর আগে একইদিন বিকেলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন আয়োজিত অপর মতবিনিময় সভায় ড. ইউনূস বলেন, 'আঁর হতা হইবাল্লাই ন আইয়ি, অনারাত্তুন জাইনত আইসসিদে' [আমরা কথা বলার জন্য আসিনি, আপনাদের কাছ থেকে জানতে এসেছি]।
এছাড়াও তিনি ওই সভায় আঞ্চলিক ভাষায় তরুণদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।