ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধবিরতি কার্যকরে যুক্তরাষ্ট্রকে যে শর্ত দিল রাশিয়া

রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি শর্তের তালিকা দিয়েছে, যা মেনে নিলে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সম্ভব হতে পারে। তবে ওই তালিকায় কী রয়েছে এবং মস্কো তা গৃহীত হওয়ার আগেই কিয়েভের সঙ্গে আলোচনায় বসবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
গত তিন সপ্তাহে রুশ ও মার্কিন কর্মকর্তারা এই বিষয়ে সরাসরি এবং ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাশিয়ার শর্তগুলো আগেও যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও ন্যাটোর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য না করা, দেশটিতে বিদেশি সেনা মোতায়েন না করা এবং ক্রিমিয়া ও আরও চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অপেক্ষা করছেন, পুতিন ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবেন কি না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি এটি শান্তি আলোচনার প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করবেন। তবে পুতিন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি।
কিছু মার্কিন কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও ইউরোপের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে।
জেলেনস্কি বলেছেন, সৌদি আরবে ইউক্রেন ও মার্কিন কর্মকর্তাদের বৈঠক ইতিবাচক ছিল। তিনি মনে করেন, ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তির ভিত্তি হতে পারে।
গত দুই দশকে রাশিয়া এ ধরনের দাবি বারবার তুলেছে। ২০২১ সালের শেষ দিকে এবং ২০২২ সালের শুরুতে, যখন রুশ সেনারা ইউক্রেন সীমান্তে অবস্থান করছিল, তখনও মস্কো এসব বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেছিল। সে সময় কিছু শর্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করলেও কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল। তবে সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি, বরং ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালায়।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন ২০২২ সালে ইস্তাম্বুলে হওয়া আলোচনার দিকে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছে। সে সময় রাশিয়া দাবি করেছিল, ইউক্রেনকে ন্যাটোর বাইরে থাকতে হবে, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং যদি কোনো দেশ ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে চায়, তবে তাতে রাশিয়ার ভেটো দেওয়ার অধিকার থাকতে হবে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যেও এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ ইস্তাম্বুল আলোচনাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, আবার কেউ মনে করছেন, নতুনভাবে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে দুটি পৃথক আলোচনা চলছে—একটি দেশ দুটির সম্পর্ক পুনর্গঠনের বিষয়ে এবং অন্যটি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের শর্ত নিয়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার শর্তগুলো শুধু ইউক্রেনের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তি তৈরি করতেই নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যৎ চুক্তির রূপরেখা ঠিক করতেও দেওয়া হয়েছে। গত দুই দশকে মস্কো একই ধরনের শর্ত যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এনেছে, যা ইউরোপে পশ্চিমাদের সামরিক উপস্থিতি সীমিত করার পাশাপাশি পুতিনের প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ করে দিতে পারে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক শীর্ষ রুশ-বিশেষজ্ঞ অ্যাঞ্জেলা স্টেন্ট বলেন, 'রাশিয়া কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে না। তাদের শর্ত বদলায়নি। আমার মনে হয়, তারা প্রকৃত অর্থে শান্তি কিংবা যুদ্ধবিরতির প্রতি আগ্রহী নয়।'
২০২২ সালে রুশ হামলার শঙ্কা তৈরি হলে বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা মস্কোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান। রুশ চাহিদা অনুযায়ী, নতুন ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর যৌথ সামরিক মহড়া নিষিদ্ধ করা, ইউরোপ বা রাশিয়ার আশপাশে মার্কিন মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন না করা এবং পূর্ব ইউরোপ, ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধ করার বিষয় নিয়ে সংলাপ হয়।
এ বিষয়ে সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা কোরি শ্যাক বলেন, 'রাশিয়া ১৯৪৫ সাল থেকেই একই দাবি জানিয়ে আসছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক কার্যক্রমে ইউরোপের দেশগুলো শুধু এটিই ভাবছে না যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ছেড়ে দিচ্ছে, বরং তারা শঙ্কিত যে, আমরা শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগ দিয়েছি।'