নিউরোসায়েন্স যেভাবে ফুটবলে বড় প্রভাবক হয়ে উঠছে
বছর চারেক আগে আর্সেন ওয়েঙ্গারকে জিগেস করা হয়েছিল, ভবিষ্যতে ফুটবলের পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হবে কোন বিষয়টি? কিংবদন্তি এই ফরাসি কোচের উত্তর ছিল, নিউরোসায়েন্স। তা এত কিছু থাকতে এই উত্তর কেন দিয়েছিলেন আর্সেনালের সাবেক এই কোচ? ওয়েঙ্গার নিজের দেওয়ার উত্তরের পেছনে কারণ হিসেবে বলেছিলেন, 'আমরা শারীরিক সক্ষমতার সর্বশেষ পর্যায়ে আছি। গত ১০ বছরে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সামর্থ্য এবং গতি বেড়েছে। এখন আপনি সব জায়গায় গতিসম্পন্ন স্প্রিন্টারদের দেখতে পাবেন। সময় হয়েছে আমাদের মস্তিষ্কের গতি বাড়ানোর।'
চার বছর পর ওয়েঙ্গার বলা সেই কথাগুলো মিলছে ধীরে ধীরে। নিউরোসায়েন্স হয়ে উঠেছে ফুটবলে এক অন্যতম প্রভাবক। ফুটবলাররা বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে নিজেদের পারফরম্যান্স করে তুলেছেন আরও ভালো। নিজেদের মস্তিষ্ককে আরও দ্রুত ব্যবহার উপযোগী করে নিজেদের সামর্থ্যের পুরোটা ঢেলে দিতে পারছেন বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই।
নিউরোসায়েন্স আসলে কী? সহজ কথায়, মানুষের স্নায়ু, বিশেষ করে মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে যে বিজ্ঞানসম্মত পড়াশোনা, সেটিই হলো নিউরোসায়েন্স। তা ফুটবলে এই নিউরোসায়েন্সের কাজ কী? কাজ হলো, এর মাধ্যমে একজন ফুটবলার বা একটি দল যদি সফল হতে চায় তাহলে তাদের মানসিক দক্ষতা বাড়ানো এবং চিন্তার মান বাড়ানো। নিউরোসায়েন্সের মাধ্যমে বোঝা সম্ভব, কার মানসিক দক্ষতা কোন পর্যায়ে রয়েছে এবং তা বাড়াতে কী করতে হবে সেটি নিয়ে কাজ করা যায়।
ফুটবলারদেরকে নিয়ে নিউরোসায়েন্টিফিক পরীক্ষার করার উদাহরণ রয়েছে অনেক। নেইমারের একটি উদাহরণই ধরা যাক। ২০১৪ সালে ব্রাজিলিয়ান তারকা ফুটবলারকে কিছু জাপানি গবেষক একটি এমআরআই মেশিনের ভেতরে ঢোকান। তাকে একটি নির্দিষ্ট ব্যায়াম করতে দেওয়া হয়, এবং সেটি করতে গিয়ে নেইমার তার মস্তিষ্কের কী পরিমাণ নিউরন এবং বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ব্যবহার করেছেন তা গবেষকরা নোট করেন। ফলাফলে দেখা যায়, নেইমার সেই ব্যায়াম করতে গিয়ে স্পেনের দ্বিতীয় বিভাগের ফুটবলারদের থেকে ৯০% কম নিউরন ব্যবহার করেছেন।
আবার আর্সেন ওয়েঙ্গারের কাছে ফিরে আসা যাক। ২০১৭ সালে আর্সেনালের নেওয়া দূরদর্শী একটি প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। সেখানে আর্সেনালের মূল দলের খেলোয়াড়দেরকে কৃত্রিম বাস্তবতার মাধ্যমে নিজেদের মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেটি বেশি সময়ের জন্য চালানো যায়নি। কারণ, কয়েকজন খেলোয়াড় অভিযোগ করেন তারা গতিজনিত অসুস্থতাবোধ করছেন।
২০২৪ সালে ইংলিশ ক্লাব উলভসের পারফরম্যান্স বিভাগের প্রধান ম্যাট পিয়ারসন জানান, ক্লাবের খেলোয়াড়দের কৃত্রিম বাস্তবতা ব্যবহার করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যেটি সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো। সেই সময়টুকুতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ম্যাচ পরিস্থিতি তৈরি করে অপেক্ষাকৃত তরুণ ফুটবলারদের তাদের ম্যাচের সময় চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই বিষয়ে পিয়ারসন বলেন, 'এর মাধ্যমে আমরা ফুটবলারদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ম্যাচ দেখাতে পারি। আর এতে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত সেরা খেলোয়াড়রাই বেশি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এই দক্ষতা বাড়াতে পারলে সেটি দারুণ কাজে দেবে।'
তা এই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষেত্রে কী কী প্রভাবক কাজ করে? এই বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছেন ব্রেইনফাস্টের প্রতিষ্ঠাতা এরিক কাস্তিয়েন। তিনি একজন সাবেক সাংবাদিক, বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়াতে সময় কাটানোর পর এরিক বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন মস্তিষ্ককে দ্রুতগতিতে কাজ করানো কীভাবে যায় তা কোনোভাবে বোঝা যায় কিনা তা বের করতে। এরিকের মতে, কোনো তথ্য একজন খেলোয়াড় কত দ্রুত বুঝতে পারেন তার ওপর নির্ভর করে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার গতি।
'লা মাসিয়াতে যারা কাজ করেন তারা একটা বিষয়ে নিশ্চিত। সেটি হলো, তাদের হাতে প্রতিভাসম্পন্ন খেলোয়াড় রয়েছে। যারা শারীরিক, মানসিক এবং কৌশলগত দিক থেকে সব ঠিকঠাক। তখন আমি তাদেরকে জিগেস করেছিলাম যে এই গুণগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী? তারা আমাকে বলেছিল, সবচেয়ে কার্যকরী যেটা সেটা আমরা শেখাতে পারি না। সেটা হলো জাদু!'
এরপর কাস্তিয়েন দুজন ডাচ নিউরোসায়েন্টিস্টের সঙ্গে কাজ করেন একটি উপায় বের করার জন্য যা দিয়ে তিনি লা মাসিয়ার কোচদের বলা সেই জাদু সম্পর্কে জানতে পারেন। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় খেলা এক হাজারেরও বেশি ফুটবলারকে সেই পরীক্ষার আওতায় আনা হয়। মাঠে তাদের খেলার মধ্যে বিভিন্ন সময়ের প্রতিক্রিয়া, সংক্ষিপ্ত সময়ে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও চিন্তা করার ধরন- এসব কিছুই বিশ্লেষণ করা হয়।
ফলাফল নিয়ে কাস্তিয়েনের বক্তব্য, 'আমরা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলা ফুটবলারদের দিয়েও এই পরীক্ষা করেছি। এরকম সর্বোচ্চ পর্যায়ে যারা খেলেন তাদের সঙ্গে একই খেলার নিচের পর্যায়ে খেলা লোকদের পার্থক্যটা কোথায়? আমরা খুঁজে পেলাম, সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা ফুটবলাররা যত দ্রুত কোনো তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারেন, নিচের পর্যায়ের খেলোয়াড়রা তার চেয়ে বেশি সময় নেন।'
কাস্তিয়েন একজন খেলোয়াড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করার গতির গুরুত্ব বোঝাতে বলেন, 'আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। স্বাভাবিকভাবে মানুষ আমাকে স্মার্ট বলে জানে। কিন্তু আপনি যদি আমাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল খেলতে দেখেন, তাহলে সেখানে আমাকে বোকা দেখাবে। আমিও আমার আশেপাশের অনেক তথ্য গ্রহণ করতে পারি ঠিকই, কিন্তু সেটাতে কিছুটা সময় লেগে যায়। এমন না যে খুব বেশি সময় লাগে, তবে সামান্য বেশি। কিন্তু এধরনের খেলাতে সেই সময়টুকুও আপনি পাবেন না।'
কাস্তিয়েন ও তার দলের বানানো মডেলটি বর্তমানে ২৫টি ক্লাব ব্যবহার করছে। যাদের মধ্যে রয়েছে পিএসভি আইন্দহোভেন, রিয়াল সোসিয়েদাদ ও সাউদাম্পটনের মতো ক্লাবগুলো। তারা প্রতিভা খোঁজার একটি মাধ্যম হিসেবে এই মডেলটি ব্যবহার করে। কাস্তিয়েন মনে করেন, অনেক খেলোয়াড়ই নিজের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা এবং সক্ষমতা বুঝতে না পারার কারণে নিজেদের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেন না।
এ ব্যাপারে কাস্তিয়েনের বক্তব্য, 'আমরা এমন অনেককেই চিনি যারা নিজেদের ১৫, ১৬ কিংবা ১৭ বছর বয়সে বেশ ভালো খেলে। এবং এর মধ্যে কেউ কেউ মূল জাতীয় দলে বা ক্লাবে সুযোগ পায়। আমি বলব না যে মস্তিষ্কই সবকিছু, কিন্তু জ্ঞানের অভাব ও মস্তিষ্কের যে ধরনের তথ্য প্রয়োজন সেসবের অভাবে বেশিরভাগ একাডেমি থেকেই খুব কম সংখ্যক খেলোয়াড় মূল দলে আসতে পারে।' কাস্তিয়েন বিশ্বাস করেন ফুটবলের সঙ্গে মস্তিষ্কের যে সম্পর্ক তা একদিন পুরোপুরিভাবে বোঝা সম্ভব হবে।
স্যালি নিডহাম নামের আরেকজন নিউরোসায়েন্টিস্টের মতে, একজন ফুটবলারের শারিরীক অবস্থার ওপরও তার মানসিক অবস্থা নির্ভরশীল। যদি কেউ অসুস্থ থাকে, যেমন সর্দি-কাশির মতো মামুলি কিছুও, সেটিও সেই খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে, 'আমরা যা ভাবি সেটাই অনুভব করি, আমরা যা অনুভব করি সেটাই আমরা ভাবি।' স্যালির মতে, খেলোয়াড়রা যদি নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেন, তাহলে এই প্রভাব অনেকটাই কমে আসবে।
নিউরোসায়েন্স যেরকম বড় পরিসর নিয়ে কাজ করে তাতে আর্সেন ওয়েঙ্গারের করা ভবিষ্যতবাণীর দিকেই এগোচ্ছে ফুটবল। খেলোয়াড়রা এখন আগের চেয়েও বেশি তথ্য পাচ্ছেন, সেগুলো কীভাবে দ্রুততম সময়ে ব্যবহার করা যায় তা বুঝতে পারছেন। এভাবে ফুটবল আরও বিবর্তিত হচ্ছে। যা দীর্ঘমেয়াদে খেলাটির জন্যই একটি ভালো সংবাদ বটে। সবচেয়ে বড় বিষয়, নিউরোসায়েন্স ব্যবহারের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের সেখানেই আরও বেশি দক্ষ করে তোলা হচ্ছে, যা তারা করতে ভালোবাসেন।
