বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়া অভিযাত্রীর ঘরে ফেরার জন্য মায়ের ২৭ বছরের অপেক্ষা
৭৫ বছর বয়সী অ্যাঞ্জেলা বুশবি বসার ঘরে চোখ বোলাচ্ছেন। ঘরজুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র অমলিন স্মৃতি। ছেলের জন্য আর কত অপেক্ষা!
দৃঢ়কণ্ঠে অ্যাঞ্জেলা বলেন, 'আমি এখানেই থাকব। চ্যানেল টানেলে যাব না। আমি এই হাল শহরে, নিজের বাড়িতেই ওর জন্য অপেক্ষা করব। ও দরজা দিয়ে ঢুকবে, আমি জড়িয়ে ধরব। তারপর জিজ্ঞেস করব—''বাড়ি ফেরার এই সময় হলো, কার্ল?''
অ্যাঞ্জেলার ছেলে কার্ল। ১৯৯৮ সালের ১ নভেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার চিলি থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল হেঁটে বাড়ি ফেরা। শর্ত একটাই—কোনো যানবাহনে চড়বেন না। ভেবেছিলেন ১২ বছর লাগবে। কিন্তু বিশ্বরাজনীতি, যুদ্ধ আর ভিসার ঝামেলার কারণে সময় লেগে গেল ২৭ বছর। এখন তিনি অস্ট্রিয়ায় ঢোকার মুখে। কার্ল আর তার পরিবার এখন ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
হালের সাটন পার্ক এস্টেটে অ্যাঞ্জেলার বসার ঘর। এটি কার্লের শৈশবের বাড়ি।
১৯৯৮ সালের পর থেকে ছেলের সঙ্গে মায়ের দেখা হয়েছে মাত্র তিনবার। এর মধ্যে ২০০৬ সালে কার্ল যখন প্রথম ব্রিটিশ হিসেবে বরফজমা বেরিং প্রণালি পার হয়ে উত্তর আমেরিকা থেকে রাশিয়ায় যান, তার আগে একবার দেখা হয়েছিল।
আরামচেয়ারে বসে ছেলের ছবির দিকে তাকান অ্যাঞ্জেলা। বলেন, 'ও আমাকে অনেক নির্ঘুম রাত উপহার দিয়েছে। আমার চুল যে সব পেকে সাদা হয়ে যায়নি, সেটাই আশ্চর্য!' তিনি আরও বলেন, 'ও এখনো আমার ছোট্ট খোকা। সব মায়েরাই এমনটা ভাবেন। সন্তান কেমন আছে বা কী করছে, সেটা কোনো বিষয় নয়।'
এই ঘরে বসেই কার্ল তার মহাযাত্রার পরিকল্পনা শুনিয়েছিলেন। বাবা কিথ ছিলেন সাবেক এসএএস সেনা। তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু মা অ্যাঞ্জেলা, যিনি একসময় স্ন্যাকস কারখানায় কাজ করতেন, তিনি আকাশ থেকে পড়েছিলেন। বললেন, 'কার্ল যখন পরিকল্পনার কথা বলল, আমি তো অবাক!'
কফি টেবিলের ওপর পারিবারিক ছবির স্তূপ। একটি ছবি নজর কাড়ে। ফর্সা চুলের একটি ছেলে গাছে চড়ছে, তার ভাই ডাল ধরে সাহায্য করছে। বড় ছেলেটির দৃষ্টি লক্ষ্যভেদী। অ্যাঞ্জেলা বলেন, 'কার্ল সবসময়ই একরোখা। একবার যেটা মাথায় চাপে, সেটা ও করেই ছাড়ে।'
দেয়ালে কার্ল আর তার ছোট ভাই আদ্রিয়ানের ছবি। দুজনেরই সেনা জীবনের স্মৃতি। কার্লের মাথায় প্যারাশুট রেজিমেন্টের মেরুন টুপি আর 'উইং' ব্যাজ। দেখে মনে হতে পারে কার্ল সহজেই এক রোমাঞ্চ থেকে আরেক রোমাঞ্চে ভেসে বেড়িয়েছেন। কিন্তু অ্যাঞ্জেলা জানান, 'ওর জন্য কিছুই সহজ ছিল না।'
কার্ল তখন বেশ ফিট হলেও কিছুটা হালকা গড়নের কিশোর ছিলেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্যারাশুট ফোর্সে ঢোকার জন্য 'পি কোম্পানি'র পরীক্ষায় তাকে বেশ কয়েকবার অংশ নিতে হয়েছিল। মায়ের মতে, জেদ আর পরিবারকে গর্বিত করার ইচ্ছাই তাকে সফল করেছে।
এই ঘরে বসেই মা ছেলেকে সান্ত্বনা দিতেন। স্কুলে তাকে বখাটেরা উত্ত্যক্ত করত। অ্যাঞ্জেলা বলেন, 'কার্লকে মোটাবুদ্ধি আর বোকা বলা হতো। অথচ ও এর কোনোটাই ছিল না। স্কুলে ওর সময়টা খুব বাজে কেটেছে।' কার্ল নিজেও ওই সময়টাকে 'নরক' বলে অভিহিত করেন।
১৩ বছর বয়সে জানা যায় কার্ল ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত। বাধার মুখে জয়ের এই গল্প অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে ভেবে মা-ছেলে দুজনেই এসব কথা প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
অ্যাঞ্জেলা বলেন, 'সমস্যার কারণ জানার পর তাকে আর থামানো যায়নি। ও পড়ার প্রতি ভালোবাসা খুঁজে পায়। আজকের এই অবস্থানে আসতে তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।'
অ্যাঞ্জেলা ছেলের অভিযানের খবর পত্রিকার কাটিং দিয়ে স্ক্র্যাপবুকে জমিয়ে রেখেছেন।
আজ পর্যন্ত কার্ল দক্ষিণ, মধ্য ও উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়ার একাংশ হেঁটে পার হয়ে ইউরোপে ঢুকেছেন। ২০২৪ সালে তিনি কাস্পিয়ান সাগরে ১৮৬ মাইল (৩০০ কিলোমিটার) সাঁতরে পার হন। ইরান বা রাশিয়ায় ভিসা জটিলতা এড়াতেই এই কঠিন পথ বেছে নেন তিনি।
হাঙ্গেরি ছেড়ে তিনি এখন অস্ট্রিয়ায় ঢুকছেন।
পরিবারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যোগসূত্র থাকলেও কার্লের জীবন এমন রোমাঞ্চকর হবে, তা কি আগে বোঝা গিয়েছিল? অ্যাঞ্জেলার উত্তর, 'তেমনটা নয়। ছোটবেলায় ও খুব শান্ত ছিল। তবে বাইরে থাকতে পছন্দ করত। রাতে তাকে ঘরে ঢোকানোই ছিল কঠিন কাজ। মাঠে পাখি দেখতে খুব ভালোবাসত।'
হাত দিয়ে জানালার বাইরের জায়গাটুকু দেখান অ্যাঞ্জেলা। বলেন, 'ও সবসময় বাইরেই থাকতে চাইত।'
গর্ব আর দুশ্চিন্তার মিশেল
বিগত দশকগুলো অ্যাঞ্জেলার জন্য গর্ব আর দুশ্চিন্তার এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে এসেছে।
২০০৬ সালের এপ্রিলের কথা মনে পড়ে তার। কার্ল তখন মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১৪ দিন ধরে নড়বড়ে বরফের প্লেটের ওপর হেঁটে রাশিয়া পৌঁছেছিলেন।
মা বলেন, 'সে পৌঁছাতে পেরেছে শুনে স্বস্তি পেয়েছিলাম। আলাস্কা ছাড়ার আগে ও পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। যদি কিছু হয়ে যায়! আমরা সবাই সেখানে গিয়েছিলাম। ও জানত, সফল না হওয়ার শঙ্কাই বেশি।'
অ্যাঞ্জেলা আরও বলেন, 'আমি কাজে ছিলাম। তখন শুনি রেডিওতে বলছে, রাশিয়ায় অবৈধভাবে ঢোকার দায়ে কার্ল গ্রেপ্তার হয়েছে। আমার বুকটা ধক করে উঠেছিল।'
আরেকবার দক্ষিণ আমেরিকায় অচেনা পানীয় পান করার অভিজ্ঞতার কথাও মনে করেন তিনি। অ্যাঞ্জেলা বলেন, 'ও জানিয়েছিল, গাছগুলো নাকি ওর দিকে হেঁটে আসছিল! আকাশটাও অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। শোনার পর আমি তো রেগে আগুন।'
ছেলেকে খুব মিস করেন মা। যাত্রার শুরুতে মাঝে মাঝে ফোন আসত। এখন মেসেঞ্জারে কথা হয়।
কার্লের জন্য উপহার জমিয়ে রেখেছেন অ্যাঞ্জেলা। তিনি বলেন, 'আমি প্রতি বছর ওর জন্য বড়দিনের উপহার কিনেছি। ফেরার পর ও অনেকগুলো উপহার একসঙ্গে খুলবে! শুনে ও বলেছিল, 'মা, তুমি পাগল হয়ে গেছ।' কিন্তু এতেই আমি শান্তি পাই।'
কার্ল ফিরে এসে সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত মা। তিনি বলেন, 'জানি না ও কী করবে। আশা করি ও এখানেই থাকবে।'
পরক্ষণেই চিন্তামগ্ন হয়ে বলেন, 'মনে হয় না ও থাকবে। এত দিন ঘুরে বেড়ানোর পর এক জায়গায় স্থির হওয়া ওর পক্ষে কঠিন।'
পরে ফোনে মায়ের সেই 'বাড়ি ফেরার এই সময় হলো?' মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয় কার্লের কাছে। তিনি উত্তর দেন, 'এটা তো একদম খাঁটি সত্যি কথা!'
